Ads Area


দশম শ্রেণীর বাংলা || সিরাজদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত) প্রশ্ন ও উত্তর || Sirajddaula Questions And Answers

 সিরাজদ্দৌলা
শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

তোমাদের আজ শেয়ার করতে চলেছি Class-10 বাংলা বই থেকে বাংলা নাট্যসাহিত্য থেকে নেওয়া সিরাজদ্দৌলা নাটকটি, এই নাটকটি থেকে কিছু প্রশ্নপত্র রয়েছে তোমাদের জন্য। তাই পরীক্ষা জন্য এই নাটক থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর তোমাদের কাছে তুলে ধরা হল, তাই আর সময় নষ্ট না করে ভালো করে এই প্রশ্ন উত্তর পড়ে নাও।


দশম শ্রেণীর বাংলা || সিরাজদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত) প্রশ্ন ও উত্তর || Sirajddaula Questions And Answers Class-10


দশম শ্রেণীর বাংলা || সিরাজদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত) প্রশ্ন ও উত্তর || Sirajddaula Questions And Answers Class-10

১)"কিন্তু ভদ্রতার অযোগ্য তোমরা।"-কে, কাকে এ কথা বলেছেন? এ কথা বলার কারণ কী? 

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকে উদ্ধৃত উক্তিটি বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা করেছেন ওয়াটসের উদ্দেশে।

 ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতায় সিরাজ যখন যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন সেই যুদ্ধ এবং প্রতিযুদ্ধের ফলস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নবাবের মধ্যে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। নবাব কলকাতার নাম রেখেছিলেন আলিনগর। ফলে এই সন্ধি 'আলিনগরের সন্ধি' নামে খ্যাত। এই সন্ধি অনুযায়ী, ইংরেজরা কোনোমতেই নবাবের বিরুদ্ধে কোনোরকম যুদ্ধযাত্রা বা যুদ্ধের আয়োজন করবে না।

কিন্তু, সিরাজের হাতে কলকাতার অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের একটি পত্র এসে পৌঁছোয়, যার মাধ্যমে সিরাজ জানতে পারেন যে, অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে তাঁর বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইতিমধ্যেই সৈন্যবাহিনী, মূলত নৌবহর পাঠিয়ে যুদ্ধযাত্রার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি এও জানতে পারেন যে, বহুদিন আগে থেকেই স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধযাত্রার ছক কষেছিলেন এবং পরিকল্পনামাফিকই আলিনগরের সন্ধির শর্তভঙ্গ করতে তাঁরা উদ্যোগী হয়েছেন। সর্বোপরি, ওয়াটসও এই ষড়যন্ত্রের এক অংশীদার। তাই কুদ্ধ, ক্ষুব্ধ সিরাজ প্রকাশ্য রাজসভায় এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন।

২)"জান এর শাস্তি কী?”- কে, কেন এ কথা বলেছেন? 

উত্তর: অ্যাডমিরাল ওয়াটসন কর্তৃক ওয়াটসকে লেখা একটি চিঠি নবাবের হস্তগত হলে তিনি বুঝতে পারেন, ওয়াটস বহুদিন ধরেই সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রের এক অংশীদার। লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে এবং অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের উদ্যোগে ওয়াটসের সক্রিয় ভুমিকা গ্রহণের মাধ্যমেই বাংলায় সিরাজের বিরুদ্ধে সৈন্যদল প্রেরিত হতে চলেছে। এমনকি, এই যুদ্ধে যে ওয়াটসের প্রত্যক্ষ প্রণোদনা রয়েছে, তা-ও সিরাজ জানতে পারেন ওয়াটসের নিজের হাতে লেখা একটি চিঠি পেয়ে।

সেই চিঠিতে ওয়াটস সরাসরি অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে জানিয়েছেন যে, সিরাজের ওপরে ভরসা করা অসম্ভব এবং অর্থহীন। ফলে ফরাসি ঘাঁটি চন্দননগর আক্রমণ করাই হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া, সিরাজ ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিস্বরূপ তাঁর দরবারে জায়গা করে নেওয়ার সুবাদে ওয়াটস তাঁর পরিবার এবং রাজসভার সদস্যদের অন্তর্কলহ ও রাজদ্রোহের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। নিজের ও কোম্পানির স্বার্থে এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে ওয়াটস যথেচ্ছ ব্যবহারও করছেন। তাই সিরাজ ওয়াটসকে এর যথোচিত শাস্তি দিতে চেয়ে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।

৩)"আমার এই অক্ষমতার জন্যে তোমরা আমাকে ক্ষমা করো।"-কে, কেন এই মন্তব্য করেছেন? যাঁকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা তাঁর মধ্যে এই মন্তব্যের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? 

উত্তর: সিরাজ ফরাসি প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা-কে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছেন।

 ইংরেজরা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর অধিকার করে নিরে নবাবের সাহায্য পাওয়ার আশায় মঁসিয়ে লা সিরাজের আসেন। নবাব সিরাজ ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও - জানান যে ইংরেজদের হারিয়ে কলকাতা জয় করতে গিয়ে এবং পূর্ণিয়ায় শওকত জঙ্গের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁর বহু লোকক্ষয় ও অর্থব্যয় হয়েছে। তাঁর মন্ত্রীমন্ডলও নতুন যুদ্ধের পক্ষপাতী নন। এই অবস্থায় সহানুভূতি থাকলেও ফরাসিদের সাহায্য করা সম্ভব নয় জানিয়ে সিরাজ মন্তব্যটি করেন।

এর উত্তরে মঁসিয়ে লা বলেছিলেন যে, সিরাজের সমস্যার কথা বুঝতে পেরে নবাবের জন্য তিনি আন্তরিকভাবেই দুঃখিত। একইসঙ্গে নিজেদের অবস্থাও তাঁকে পীড়িত করেছে। ভালোবাসার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় নেই। এই সঙ্গেই তিনি নবাবকে তাঁর ভাবী বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে দেন এবং জানান যে, তাঁরা বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে চাপা আগুন জ্বলে উঠবে, তাতে নবাবের সাম্রাজা ধবংস হয়ে যাবে।

৪)"I know we shall never meet"-কে, কাকে এ কথা বলেছেন? এই বক্তব্যের পূর্বপ্রসঙ্গ কী ছিল?

উত্তর: উদ্ধৃত উক্তিটি শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকে সংকলিত 'সিরাজদ্দৌলা' পাঠ্যাংশ থেকে গৃহীত।

বাংলায় ফরাসি বণিকদের প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা উদ্ধৃত উক্তিটি বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার উদ্দেশে করেছিলেন। 

 ইংরেজরা বাংলায় ফরাসিদের বিরদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন শুরু করলে ফরাসিদের পক্ষে তা ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, ইতিপূর্বেই ফরাসিরা ইংরেজ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুর্গনির্মাণের চেষ্টা করলে নবাবই তাতে আপত্তি জানান। নবাবের আদেশ ফরাসিরা শিরোধার্য করলেও ইংরেজরা তা মানেনি। ফলে বাংলায় সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকা ফরাসিরা হঠাৎ আক্রমণের মুখোমুখি হলে, তাদের পক্ষ থেকে মঁসিয়ে লা নবাবের কাছে সামরিক সাহায্যপ্রার্থী হয়ে আসেন। কিন্তু সিরাজের পক্ষে সেই মুহূর্তে এই প্রত্যাশা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ, ইতিপূর্বেই কলকাতা জয়ে এবং পূর্ণিয়ার যুদ্ধে তাঁর লোকবলও অর্থবল যথেষ্ট কমে যায়। ফলে নবাবের কাছ থেকে সাহায্য না পেয়ে ব্যথিত মঁসিয়ে লা এ কথা বলেন।

৫)"শেঠজি, জাফর আলি খাঁ, আপনাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধুর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখুন।"- কেন সিরাজ এইভাবে বিলাপ করেছেন?

উত্তর: সিরাজদ্দৌলা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচারী কিছু সভাসদদের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিতন্ডার একটি খন্ড মুহূর্তে ধরা পড়ে এই উদ্ধৃতির মধ্যে। রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, মীরজাফর প্রমুখ নবাবের বিরুদ্ধে উপদ্রব ও অনাচারের যে অভিযোগগুলি আনেন তাতে কুদ্ধ, ব্যথিত এবং হতাশ সিরাজ একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য খণ্ডনে উদ্যত হন। রাজবল্লভ, যাঁকে এখানে 'বন্ধু' বলে অভিহিত করা হয়েছে তিনি সিরাজের পাপাচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললে নবাব হোসেনকুলীর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। হোসেনকুলী, যিনি পাপপূর্ণ কাজে লিপ্ত ছিলেন, তিনি সিরাজের কথামতো "প্রাণ দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়ে" যান। নবাব জানতে চান রাজবল্লভও হোসেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চান কিনা।

এমন কুদ্ধ, হুমকি-মেশানো জিজ্ঞাসায় ভীত, সংকোচিত ও অপমানিত রাজবল্লভ নিজের মাথা নীচু করেন। এই অংশের বাদানুবাদের শেষ হয় সিরাজের করা উদ্ধৃত বক্তব্য পেশের মাধ্যমে। এই উক্তি প্রকৃতপক্ষে মীরজাফর ও শেঠজিকে উদ্দেশ্য করে করা এবং তাতেও কিন্তু ভয় দেখানোর ধরন ফুটে উঠেছে।

৬)"আমরা নবাবের নিমক বৃথাই খাই না, এ কথা তাঁদের মনে রাখা উচিত।"-কে এ কথা বলেছেন? মন্তব্যটির প্রেক্ষাপট নাট্যদৃশ্য অবলম্বনে লেখো। 

উত্তর: প্রশ্নোদ্ভূত কথাটি বলেছেন নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন।

 নবাব সিরাজদৌলা বিশ্বাসভঙ্গের জন্য ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস্ম্পকে তাঁর দরবার ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে গোপন সমঝোতা হয়েছিল সিরাজের যেসব উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের, তারা এর বিরোধিতা করে। সিরাজের আচরণে জগৎশেঠ বিষোদ্গার করে, মীরজাফর সিরাজের বিরুদ্ধে 'মানী-লোকের মানহানি' করার অভিযোগ আনে। এমনকি সিপাহসালার মীরজফর জানিয়ে দেয় যে, সিরাজ এভাবে চললে তাঁর হয়ে অস্ত্রধারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।

এই সমবেত আক্রমণের সময়ে সিরাজের পাশে দাঁড়ায় তাঁর বিশ্বস্ত দুই সেনাপতি মীরমদন ও মোহনলাল। মীরমদন মীরজাফরের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো যুদ্ধে সক্রিয় না হওয়ার অভিযোগ আনে। মীরজাফর অধস্তনের এই ঔদ্ধত্য মানতে না পারার কথা বললে মোহনলাল তাকে মনে করিয়ে দেন, 'নবাবের কাজের সমালোচনাও সব সময়ে শোভন নয়।' এই প্রেক্ষাপটেই মীরমদন মনে করিয়ে দেন নবাবের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা। সেনাপতি, আমির ওমরাহরা যেভাবে রাজাকে ক্ষমতাহীন ভাবছে, তাতেও তাঁর ক্ষোভ প্রকাশিত হয়।

৭) “গোলাম হোসেন, মোহনলাল আর মীরমদন যখন রয়েছে, তখন আর ভাবনা কী? চলুন।”- উদ্ধৃতাংশের বক্তা কে? তিনি কাদের, কেন সঙ্গে নিয়ে চলে যেতে চান?

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে উদ্ধৃত উত্তিটির বক্তা নবাব সিরাজের সিপাহসালার মীরজাফর।

বাংলার নবাবি রাজত্বের গৃহকোন্দলের একটি স্পষ্ট মুহূর্ত ধরা পড়েছে নাট্যাংশের এই অংশে। সিরাজকে সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়ে যেতে চান যাঁরা, সেই মোহনলাল, মীরমদন এবং গোলাম হোসেনদের পদ, তাঁদের ক্ষমতা এবং নবাবের বিচক্ষণতাকে কটাক্ষ করে করা এই মন্তব্যে মীরজাফরের সিরাজের শিবির ত্যাগ করে বিরোধী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে যোগদানের ইচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মীরমদন এবং অন্যরা যখন মীরজাফরের নিষ্ক্রিয়তা, নবাবের স্বপক্ষে অস্ত্রধারণে অনীহার সমালোচনা করেন এবং অনিবার্যভাবেই উভয়পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ পালটা দোষারোপ চাপাতে থাকে তখন মীরমদন নবাবকে পূর্ণ সাহায্যদানের কথা ঘোষণা করলে ক্ষিন্তু সিপাহসালার তাঁর অনুগামী জগৎ শেঠ, রায়বল্লভদের নিয়ে দরবার ত্যাগ করতে উদ্যত হন।

বস্তুতপক্ষে মীরজাফরের এমন কটাক্ষ এবং অভিযোগ আসলে অজুহাতমাত্র। তাঁদের নবাবের সঙ্গত্যাগ একপ্রকারের অবশ্যম্ভাবী ঘটনাই ছিল।

৮) "আজ বিচারের দিন নয়, সৌহার্দ্য স্থাপনের দিন।”-কে কার উদ্দেশে এই উক্তি করেছেন? বক্তার এমন উক্তির কারণ কী?

উত্তর: মীরজাফর নবাবের উদ্দেশে যখন বলেছেন- "নবাব কি প্রকাশ্য দরবারেই আমার বিচার করতে চান?" সেই সময় মীরজাফরের এই প্রশ্নের উত্তরে স্থিতধী নবাব আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

 সিরাজ বুঝে গেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বহুদূর বিস্তৃত। ইংরেজদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছেন মীরজাফর, রাজবল্লভ-সহ তাঁর কিছু কর্মচারী। নিজের মাসি ঘসেটি বেগমও সেই ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। এই অবস্থায় ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গেলে হিতে বিপরীতই হবে। মীরজাফরকে শান্তি দিলে তাঁর ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়া হবে। তার বদলে তাঁকে বিনীতভাবে বুঝিয়ে সুপথে আনা গেলে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষিত হবে।

নবাব জানেন, মীরজাফর একা নন, তাঁর আরও কিছু কর্মচারী তাঁর বিরুদ্ধোবজ বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য প্রস্তুত। তাই নিজে সংযত হয়ে বিচারের প্রসঙ্গটিকে দূরে রাখতে চেয়েছেন। বাংলা যখন বিপন্ন, নবাবের সিংহাসন যখন টলমল করছে, তখন ক্রোধ সংবরণ করাই শ্রেয়। তাই সিরাজ বিনম্র চিত্তে নিজের এবং বাংলার দুর্দশার কথা শুনিয়ে মীরজাফরের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।

৯)"বাংলার এই দুর্দিনে আমাকে ত্যাগ করবেন না।”-কে, কাদের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন? এই উক্তির মধ্যে দিয়ে বক্তার কোন্ মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে, লেখো। 

উত্তর: বিশিষ্ট নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা এ কথা বলেছেন সিপাহসালার মীরজাফর ও তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্য করে।

 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে। কলকাতা এবং কাশিমবাজারে তাঁদের দুর্গনির্মাণ অব্যাহত। এরমধ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে স্বয়ং মীরজাফর ও ঘসেটি বেগম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। বিচক্ষণ সিরাজ বুঝেছেন এই পরিস্থিতিতে তাকে ধৈর্য হারালে চলবে না। নিজেকে সংযত রেখে মনোমালিন্য মিটিয়ে নিতে হবে। তাই মীরজাফর ও তাঁর অনুগামীদের যাবতীয় অভিযোগ মাথা-পেতে বিজনয়ে সৌহার্দ্য- স্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন।

নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে মীরজাফরের কাছে বিনীত আবেদন জানিয়েছেন তাকে যেন তিনি বাংলার ঘোর দুর্দিনে ত্যাগ না করেন। এই উক্তির মধ্যে সিরাজের বিনয়ী স্বভাবের পরিচয় পাওয়া গেলেও তার নেপথ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে তাঁর অসহায়তা। শুধু বাংলার স্বাধীনতারক্ষার জন্য সিরাজ শত্রুর কাছেও মাথা নত করতে প্রস্তুত। উক্তিটি ি নবাবের দেশপ্রীতিরই পরিচায়ক।

১০)"বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়-মিলিত হিন্দু মুসলমানের মাতৃভূমি এই গুলবাগ বাংলা।”-কে উক্তিটি করেছেন? এই উক্তির আলোকে বক্তার মনোভাবের পরিচয় দাও। 

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে নবাব সিরাজদ্দৌলা মন্তব্যটি করেছেন।

সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই নবাবের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র চলতে তাকে। মীরজাফরের নেতৃত্বে আলাদা একটা দল গড়ে উঠেছে। রাজা রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ প্রভৃতি হিন্দু ইং সেনাপতিরা যেন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে বিশ্বাস করেন না। বাংলা কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য নয়। হিন্দু- সিভ মুসলমানের মিলিত বাসভূমি গুলবাগ এই বাংলা।

ইংরেজরা বিদেশি জাতি। তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া মানেই দেশদ্রোহিতা। ব্যক্তিমানুষের রাগ বা অনাস্থা প্রকাশ করে বিদেশি শক্তিকে উপ আবাহন করে আনা দেশদ্রোহিতার নামান্তর। তাই ইংরেজদের শক্তিবিস্তার রোধ করতে হলে হিন্দু-মুসলমান সকলকেই ইন্ডি আত্মনিয়োগ করতে হবে। নিজেরা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে কোম্পানির কাছে বাংলা দখল করাটা সহজ হয়ে উঠবে। সেই কারণেই ধর্মপরিচয়কে দূরে সরিয়ে রেখে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার সর্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। উক্তিটি সিরাজের অমলিন উদারনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।

১১) "সুতরাং আমি মুসলমান বলে আমার প্রতি আপনারা বিরূপ হবেন না।”- উদ্ধৃতিটির বক্তা কে? তাঁর এরূপ বিলাপের কারণ কী?

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত উদ্ধৃতাংশটির বক্তা হলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা স্বয়ং। 

 স্বাধীন নবাবি আমলের অন্তমিত পর্যায়ের খানিক আভাস নাট্যকার তুলে ধরেছেন আলোচ্য নাট্যাংশে। নবাব সিরাজের করে। বিরোধী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল নবাব নিজের নির্মাণ গৃহবিবাদে লিপ্ত থাকায়। একদিকে জগৎ শেঠ, মীরজাফরের মতো সভাসদদের অসহযোগিতা, অন্যদিকে ঘসেটি বেগম ও অনাদের -এই ব্যক্তিগত স্তরে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার বাসনা -যত সিরাজদ্দৌলাকে বিধস্ত করেছিল।

তবুও তিনি ঘরোয়া কোদর, তাঁর রাজসভার বিবাদ যথাস্থানে মিটিয়ে এক এবং একমাত্র শু ভাদ্য- হিসেবে ব্রিটিশ কোম্পানিকেই চিহিত করতে চেয়েছিলেন। এরজনা নিয়ে তিনি পারস্পরিক দোষারোপের বদলে নিজেদের ত্রুটি সংশোধনে জনি মন দিতে বলেন, নবাব বাদ দেননি নিজেকেও। ইতিপূর্বে তিনি নিজে জের যা, যা ভুল করেছেন, যে, যে ভুলের কারণে আঘাত দিয়েছেন হিন্দু কট ও মুসলিম ধর্মের মানুষদের, তাদের প্রত্যেকের কাছে তিনি ভার করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। হিন্দু ও মুসলিম উভয়কেই ধর্মীয় টি বিভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে ওঠার পরামর্শ দিয়েছেন এবং তারই প্রেক্ষিতে বিনীত স্বরে তিনি মন্তব্যটি করেছেন।

১২)"জাতির সৌভাগ্য-সূর্য আজ অস্তাচলগামী।” -সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখো।

উত্তর: নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা' নামক নাট্যাংশে নবাব সিরাজদ্দৌলা তাঁর রাজদরবারের বিশিষ্ট কর্মচারীদের উদ্দেশে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

আলিবর্দির মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে বসেন তাঁর দৌহিত্র ন সিরাজদ্দৌলা। সিংহাসন আরোহণের পরই নানা কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। - ইংরেজরা বিনা শুল্কে ব্যাবসাবাণিজ্য শুরু করে। নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ করতে থাকে। সিরাজের সিংহাসন আরও কণ্টকিত হয়ে ওঠে নিজের মাসি ঘসেটি বেগম, প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও কিছু রাজকর্মচারীর ষড়যন্ত্রে।

বাংলার এই ঘোর দুর্দিনে সিরাজ সকলের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তব্যে বাংলাকে ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা করার করুণ আবেদন ধ্বনিত হয়। যেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা বিস্তার করেছে, তাতে অনতিবিলম্বে বাংলা তার স্বাধীনতা হারাবে। "বাঙালি জাতির সৌভাগ্যসূর্য আজ অন্তাচলগামী।”- সিরাজের এই উক্তির মধ্যে গভীর বেদনাবোধ ধরা পড়েছে। বাংলার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশরূপে উদ্ধৃতিটি হৃদয়স্পর্শী।

১৩)"তাঁর আদেশে হাসিমুখেই মৃত্যুকে বরণ করব।”-এখানে কার আদেশের কথা বলা হয়েছে? এই উক্তির আলোকে বক্তার চরিত্রটির ওপর আলোকপাত করো। 

উত্তর: বিশিষ্ট নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকে মীরমদন এই শপথবাক্যটি উচ্চারণ করেছেন। তিনি সিপাহসালার মীরজাফরের আদেশকেই মান্য করতে চান। 

 পলাশির যুদ্ধে সিরাজের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদনের ভূমিকা ইতিহাসের পাতার স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। বাংলার ঘোর 

 দুদিনে সিরাজের অসহায়তার কথা অনুধাবন করে মীরমদনও এতে বিচলিত হয়েছেন। নবাবের বেদনাবোধের সঙ্গে সহমর্মী হয়ে তিনি এক জীবনপণ লড়াইয়ের শপথ গ্রহণ করেছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় মীরমদন বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রতিপক্ষের কামানের গোলায় পলাশির প্রান্তরেই প্রাণ হারান। আলোচ্যমান উক্তিটি * বোধহয় সেই প্রাণ বলিদানের পূর্বাভাস।

সিরাজ চেয়েছিলেন হিন্দু- মুসলমানের মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলার স্বাধীনতা রক্ষিত হোক। সর্বপ্রকার কলুষতা মুছে ফেলে যৌথ প্রয়াসেই কোম্পানিকে রুখে দিতে হবে। মীরমদন নবাবের এই অভিপ্রায় আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। মীরজাফরের আচরণ তাঁর কাছে সন্দেহজনক ছিল। কিন্তু তাঁর শপথ মীরমদনকেও উজ্জীবিত করেছে। মানসিক দিক থেকে তিনিও প্রশান্তি লাভ করেছেন। উক্তিটি তাঁর অমলিন দেশপ্রেমের হিরণ্যদ্যুতি।

১৪)"ওখানে কী দেখচ মূর্খ, বিবেকের দিকে চেয়ে দ্যাখো!" উদ্ধৃতাংশের বক্তা কাকে 'মূর্খ' বলে সম্বোধন করেছেন? তাঁর এরূপ বিরূপ মন্তব্যের কারণ কী?

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখিত 'সিরাজদ্দৌলা' শীর্ষক নাট্যাংশে ঘসেটি বেগম নবাব সিরাজকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছেন।

 ঘসেটির প্রকৃত নাম মেহেরুন্নিসা। তিনি নবাব আলিবর্দি খাঁ-র জয় বড়ো মেয়ে, সম্পর্কে সিরাজের মাসি। ঘসেটির বিয়ে হয় ঢাকার ভয় শাসনকর্তা শাহমৎ জঙ্গ-এর সঙ্গে। দত্তক পুত্র ইকরমের মৃত্যু হলে তার শোকে শাহমৎ জঙ্গ-ও মারা যান। বিধবা ঘসেটি - বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেও আলিবর্দি খাঁ-র মনোনীত সিরাজদ্দৌলার হাতে যায় বাংলার শাসনভার। ঈর্ষান্বিত ঘসেটি আলিবর্দির মেজো মেয়ের ছেলে শওকত জঙ্গকে সিরাজের প্রবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।

বাংলার নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর এরপরে ঘসেটি রাজবল্লভ ও অন্যদেরও নিজের দলে টানেন। ক্ষিপ্ত সিরাজ এরপর ক্রমে, ক্রমে ঘসেটির মতিঝিলে প্রবেশাধিকার রুদ্ধ * করেন, নিজের রাজপ্রাসাদে নজরবন্দি করে রাখেন, তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাঁরই আদেশে সংঘর্ষে নিহত হয় শওকত এর জঙ্গ। ঈর্ষান্বিত ঘসেটি পরিণত হন প্রতিহিংসাপরায়ণ চরিত্রে। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সমস্ত রাস্তা একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষিন্তু ঘসেটি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে মন্তব্যটি করেন।

১৫)"মনে হয়, ওর নিশ্বাসে বিষ, ওর দৃষ্টিতে আগুন, ওর অঙ্গ সঞ্চালনে ভূমিকম্প।”-কে, কার সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছে? তার সম্পর্কে বক্তার এরূপ মন্তব্যের কারণ কী? 

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে, নবাব সিরাজদ্দৌলার পত্নী লুৎফাউন্নিসা ঘসেটি বেগম সম্পর্কে এ কথা বলেছেন।

 ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সিরাজ বিচলিত হয়ে তাঁর সিংহাসন সত্যই টলছে কি না পরীক্ষা করছিলেন। এই সময় নবাবের

মাসি ঘসেটি প্রবেশ করেন এবং একের পরে এক তীর বাক্যবাণে ঘসেটি বেগম সিরাজকে জর্জরিত করতে থাকেন। ঘসেটির প্রতিটি বাকাই বিষ-মাখানো তিরের মতো যেমন সিরাজের হৃদয়ে বিঁধে যায়, তেমনি সেখানে উপস্থিত লুৎফার অন্তরকেও ক্ষতবিক্ষত করে। তিনি বুঝতে পারেন ঘসেটি সাক্ষাৎ প্রতিহিংসা, যিনি শওকতজঙ্গের মতো তাঁর স্বামীর নির্মম পরিণতি চান। তাঁর সর্বাঙ্গে অতৃপ্তির জ্বালা, নিশ্বাসে বিষ, দৃষ্টিতে আগুন আর অঙ্গ সঞ্চালনে ভূমিকম্পের অনুরখন। ঘসেটিকে সহ্য করতে না পেরে লুৎফাউন্নিসা তাঁকে অবিলম্বে মতিঝিলে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। উক্তিটির মধ্যে ঘসেটি সম্পর্কে লুৎফার ভীতি এবং আশঙ্কাই প্রকাশিত হয়েছে।

১৬)"তাই আজও তার বুকে রক্তের তৃষা।"-কার বুকে, কেন রক্তের তৃষা বলে বক্তা মনে করেছেন? এই উক্তির আলোকে বক্তার মানসিকতার পরিচয় দাও। 

 উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যদৃশ্যে বাংলার নবাব সিরাজ পলাশির প্রান্তরে রক্তের তৃষাকে দেখেছেন। তাঁর ভাবনায় পলাশি নামের একটি তাৎপর্য ধরা পড়েছে। একসময় হয়তো লাখে লাখে পলাশ ফুল ফুটে প্রাপ্তর রাঙা হয়ে থাকত। সেই কারণেই স্থানটির নাম হয় পলাশি। আর আজ সেই প্রান্তর যেন ব্রিটিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলার মানুষের বুকের রক্ত পিপাসার জন্য উন্মুখ।

 ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্রের শিকার সিরাজদ্দৌলা। একদিকে সেনাপতি মীরজাফর অন্যদিকে সিরাজের নিজের মাসি ঘসেটি বেগম সিরাজের পতনের জন্য হীন কর্মে লিপ্ত। বিচক্ষণ সিরাজ বুঝতে পেরেছেন এর ফলস্বরূপ ইংরেজ কোম্পানি আরও মরিয়া হয়ে উঠবে সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। পলাশির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ভেবে তিনি গভীরভাবে হতাশ হয়েছেন। কারণ এই যুদ্ধে জয়লাভের কোনো আশা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। একসময় পলাশ ফুলে লাল হয়ে থাকা পলাশি যেন রক্তের তৃয়ায় আকুল হয়ে আছে।

১৭)"জানি না, আজ কার রক্ত সে চায়। পলাশি, রাক্ষসী পলাশি"- সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: উদ্ধৃত উক্তিটি নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে নবাব সিরাজের শেষতম মন্তব্য।

কখনোই কোনো যুদ্ধের আগাম পরিণাম জানানো যায় না। পলাশির যুদ্ধের মতো যুদ্ধের ক্ষেত্রে তো নয়ই। কারণ এই যুদ্ধে লিপ্ত ছিল একাধিক পক্ষ এবং প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্যে আলাদা আলাদা রকমের। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, পারবিারিক প্রতিহিংসা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বাসনা-ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা এর সঙ্গে মিশে ছিল। তাই লড়াইটা যে নিছক সিরাজ বনাম কোম্পানি ছিল না সেটা নবাব নিজেও বুঝেছিলেন। তাঁর সপক্ষে আজ যারা দাঁড়াচ্ছেন সেই মীরজাফর, রাজবল্লভ যে কাল তাঁর পাশে নাও থাকতে পারেন-

এই সত্যটি বুঝতে সিরাজের কোনো অসুবিধেই হয়নি। তবে সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য, যুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী এবং সুনিশ্চিত। তবে যুদ্ধের পরিণাম পক্ষে বা বিপক্ষে যে-কোনো দিকেই যেতে পারে। এই যুদ্ধ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যার সংঘটনস্থল পলাশি। আগামী ক্ষয় ও বিনষ্টির ছবিটি আগাম দেখতে পেয়ে তাই সংবেদনশীল নবাবের হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে, যার প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্চ মন্তব্যের মাধ্যমে।

১৮) এই মুহূর্তে তুমি আমার দরবার ত্যাগ করো।”- বক্তা কাকে, কেন দরবার ত্যাগ করার আদেশ দিয়েছিলেন?  

উত্তর: সিরাজদ্দৌলা তাঁর দরবারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াটস্কে উদ্দেশ্য করে আদেশটি দিয়েছিলেন।

 একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজদের অপরাধ যে সভ্যতার এবং শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করেছে তা স্পষ্ট করে দেন সিরাজদ্দৌলা। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের পত্রটিকে সামনে এনে তিনি দেখান যে সেখানে কর্নেল ক্লাইভের কথামতো কলকাতায় সৈন্য সমাবেশের কথা আছে। চিঠির শেষে লেখা ছিল-"বাংলায় আমি এমন আগুন জ্বালাইব, যাহা গঙ্গার সমস্ত জল দিয়াও নিভানো যাইবে না।" ওয়াটস্ এই চিঠির দায় নিতে অস্বীকার করলে নবাব ওয়াটসের লেখা চিঠিটি বের করেন।

সেই চিঠিতে লেখা ছিল যে, নবাবের ওপরে নির্ভর করা অসম্ভব এবং চন্দননগর আক্রমণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই অভদ্রতা এবং ঔদ্ধত্যের কথা বলতে গিয়ে সিরাজ ইংরাজদের বিরুদ্ধে তাঁর সভাসদদের উত্তেজিত করার অভিযোগও আনেন। ওয়াটসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় কলকাতার ইংরেজ প্রশাসনকে নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করতে প্ররোচিত করার জন্য। আর এসবেরই শাস্তি হিসেবে নবাব সিরাজ ওয়াটস্কে দরবার ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

১৯)"তোমাদের কাছে আমি লজ্জিত।”-বক্তা কাদের কাছে কেন লজ্জিত? 

উত্তর: 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে নবাব সিরাজদ্দৌলা ফরাসি প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা-কে ফরাসিদের কাছে লজ্জিত হওয়ার কথা বলেছেন।

'সঁসিয়ে লা সিরাজের দরবারে এসেছিলেন চন্দননগর ইংরেজদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য নবাবের সাহায্য প্রার্থনা করতে। নবাব ফরাসিদের সঙ্গে বাংলার দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। নবাবের সঙ্গে তারা যে কখনও অসদ্ব্যবহার করেননি সে-কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেন। ইংরেজরা তাঁর সম্মতি না নিয়ে চন্দননগর অধিকার করেছে, সমস্ত ফরাসি বাণিজ্যকুঠি ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে, তিনি যে এসব বিষয়ে অবহিত, নবাব তা-ও জানান।

কিন্তু কলকাতা জয় করতে গিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে এবং পূর্ণিয়ায় শওকত জঙ্গের সঙ্গে লড়াইয়ে যে তাঁর প্রচুর লোকক্ষয় এবং অর্থব্যয় হয়েছে নবাব সে- কথা জানান। তা ছাড়া নবাবের মন্ত্রীমন্ডলও নতুন করে কোনো যুদ্ধে আগ্রহী নন। সেই কারণে ফরাসিদের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি থাকলেও তাঁর পক্ষে যে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। সম্ভব নয় তা নবাব উল্লেখ করেন। এই অক্ষমতার জন্য মঁসিয়ে লা র কাছে নবাব সিরাজদ্দৌলা ক্ষমা প্রার্থনা ও লজ্জা প্রকাশ করেন।

২০) "বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।”-বক্তা কে? বক্তার এমন ধারণা হওয়ার কারণ কী? 

উত্তর: 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশের উল্লিখিত অংশটির বস্তা নবাব সিরাজদ্দৌলা স্বয়ং।

নবাব সিরাজদ্দৌলা তাঁর দরবারে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যেমন-জগৎশেঠ, রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ প্রমুখের সামনে মন্তব্যটি করেন। নবাব কলকাতা দুর্গ দখল করার পরে ইংরেজরা তাদের সৈন্যশক্তিকে সংহত করে নিয়েছিল। নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে তারা চন্দননগর দখল করে নিয়েছিল। কাশিমবাজারের দিকে ইংরেজদের অভিযানও হচ্ছিল। সবমিলিয়ে নবাবের দৃষ্টিতে বাংলার জন্য ছিল তা এক 'দুর্দিন'। আর তার সঙ্গেই নিজের রাজ্যমধ্যেই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে নবাব পাচ্ছিলেন প্রত্যক্ষ বিরোধিতা।

তাঁর সিপাহসালার মীরজাফর এমনও বলেছিলেন-"আপনি যদি মানী লোকের এইরূপ অপমান করেন, তাহলে আপনার স্বপক্ষে কখনও অস্ত্র ধারণ করব না।" মীরজাফর জগৎশেঠদের বাংলার দুর্দিনে এক হয়ে চলার কথা বললেও দে- বিষয়ে সিরাজ নিজেই সংশয়ে ছিলেন। সব মিলিয়ে দেশের সামনে যে মহাবিপদ উপস্থিত হয়েছে সে বিষয়ে সিরাজ নিশ্চিত ছিলেন।

২১)"আমার উপদ্রব নয় শেঠজি, আমার সহিষুতাই আপনাদের স্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে!"-কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে? সহিষ্ণুতা কার স্পর্ধা বাড়িয়েছে এবং কীভাবে?

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে নিজের দরবারে নবাব সিরাজ মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁর রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেঙ্গ। সেখানে রাজা রাজবল্লভ স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস্কে নবাব অপমান করে না তাড়ালেই পারতেন। জগৎশেঠ নবাবের বিরুদ্ধে অবিবেচনার অভিযোগ আনেন। পাল্টা হিসেবে সিরাজ তাঁদের বিরুদ্ধে স্বার্থসিন্ধির অভিযোগ আনলে জগৎশেঠ বলেন যে স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইলে "বাংলার সিংহাসনে এতদিনে অন্য নবাব বসতেন।” সিরাজ এতে দুঃসাহস দেখলে জগৎশেঠ বলেন-"আপনার উপদ্রবই আমাদের মনে এই সাহস এনে দিয়েছে।" এর উত্তরদান প্রসঙ্গেই সিরাজ উদ্দিষ্ট মন্তব্যটি করেন।

সিরাজের মতে তাঁর সহিমুতা স্পর্ধা বাড়িয়েছে রাজা রাজবল্লর্ড রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রমুখদের। এই সহিমুতা তাদের - নবাবের মুখের সামনে কথা বলার সাহস জুগিয়েছে, ইংরেজদের হয়ে কথা বলার স্পর্ধা দিয়েছে। এমনকি নবাববিরোধী চক্রাধে সামিল হতেও তাদের পিছপা করেনি।

২২)"বেগমকে আজীবন আমারই মতো কেঁদে কাটাতে হবে।"-'বেগম' কে? 'আমার মতো' বলতে কার কথা বলা হয়েছে? তার কেঁদে কাটানোর কারণ কী? 

উত্তর: শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশের উল্লিখিত অংশে 'বেগম' বলতে নবাব সিরাজদ্দৌলার পত্নী লুৎফার কথা বলা হয়েছে।

 'আমার মতো' বলতে এখানে ঘসেটির কথা বলা হয়েছে।

 নবাব আলিবর্দী খাঁ-র জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটি বেগমের রাজনৈতিক উচ্চাশা ছিল যে, আলিবর্দীর পরে তিনি বাংলার শাসনক্ষমতার অধিকারী হবেন। তাই সিরাজকে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেন নি। পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন তিনি। যদিও নবাব সিরাজদ্দৌলা তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদ একসময় হয়ে ওঠে নবাববিরোধী ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র।

সিরাজ 'এসব বুঝতে পেরে ঘসেটিকে মতিঝিল থেকে উৎখাত করেন এবং মুরশিদাবাদে নিজের প্রাসাদে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখেন। ঘসেটি আক্ষেপের সঙ্গেই বলেন- "অনাথা বিধবা আমি, নিজের গৃহে দুঃখকে সাথি করে পড়েছিলাম, অত্যাচারের প্রতিকারে অক্ষম হয়ে ডুকরে কেঁদে সান্ত্বনা পেতাম।" এই কান্নাই সিরাজের পথকে অস্পষ্ট করে দেয়।

২৩) "আছে শুধু প্রতিহিংসা”-মন্তব্যটি কার? কী কারণে সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে? 

উত্তর: 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশে প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন ঘসেটি বেগম।

 নবাব আলিবর্দি খাঁ-র জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটি বেগম তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশার কারণে বাংলার সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু আলিবর্দি-মনোনীত সিরাজদ্দৌলা বাংলার নবাব হলে ঘসেটি তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি আলিবর্দির আর এক দৌহিত্র শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চান। ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদ হয়ে ওঠে সিরাজবিরোধী চক্রান্তের কেন্দ্রস্থল। নবাব সিরাজ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মতিঝিল প্রাসাদের দখল নেন এবং ঘসেটিকে নিজের মুরশিদাবাদের প্রাসাদে নজরবন্দি করে রাখেন। ঘসেটি পরিণত হন সিরাজের প্রত্যক্ষ বিরোধীতে।

ইংরেজদের কাশিমবাজার অভিমুখে আগমনের খবর পেয়ে তিনি প্রত্যাশা করেন মুরশিদাবাদেও তারা আসবে এবং বাংলার সুদিন ফিরবে-“ঘসেটির বন্ধন মোচন হবে, সিরাজের পতন হবে...।" সিরাজ তাঁকে গৃহহারা করেছে, তাঁর সর্বস্ব লুঠ করেছে, তাঁকে দাসী করে রেখেছে। তাঁর এই অভিযোগ অস্বীকার করতে চেয়ে সিরাজ বলেন যে রাজনীতির কারণে মতিঝিল প্রাসাদে তাঁকে যেতে নিবৃত্ত করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘসেটি বলেন যে তাঁর রাজ্য নেই, রাজনীতি নেই, আছে শুধু প্রতিহিংসা।

২৪)"মুন্সিজি, এই পত্রের মর্ম সভাসদদের বুঝিয়ে দিন।”-কোন্ পত্রের কথা এখানে বলা হয়েছে? মুন্সিজি সেই পত্রের যে তরজমা শুনিয়েছিলেন তা নিজের ভাষায় লেখো। 

উত্তর: উদ্ধৃত উক্তিটি শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত 'সিরাজদ্দৌলা' নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকে সংকলিত সিরাজদ্দৌলা পাঠ্যাংশ থেকে গৃহীত। 'সিরাজদ্দৌলা' নাট্যাংশের উল্লিখিত অংশে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের পত্রের কথা বলা হয়েছে।

 ইংরেজদের অপরাধ যে সভ্যতা এবং শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করেছে, তা উল্লেখ করতে গিয়ে নবাব সিরাজদ্দৌলা ওয়াটসনের পত্রটির কথা উত্থাপন করেন। মুন্সিকে দিয়ে প্রথমে পত্রটির শেষ অংশ পড়ান, তারপরে সভাসদদের বোঝানোর জন্য তার তরজমা করতে বলেন। সেই অনুবাদের বক্তব্য হল-কর্নেল ক্লাইভের প্রত্যাশামতো সৈন্যদল শীঘ্রই কলকাতায় এসে পৌঁছোবে। তিনি অতি দ্রুত আর একটি জাহাজ মাদ্রাজে পাঠিয়ে সংবাদ দেবেন যে, আরও সৈন্য এবং জাহাজ বাংলায়, আবশ্যক। সবশেষে প্রায় হুমকির সুরে ওয়াটসন বলেন যে বাংলায় তিনি এমন আগুন জ্বালাবেন যা গঙ্গার সমস্ত জল দিয়েও নেভানো যাবে না।

আরও পড়ুন-

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area