Ads Area


ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা

সুপ্রিয় পাঠকগন আমাদের এই নতুন পোষ্টে স্বাগতম, এই পর্বটিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা বা কৃতিত্ব সম্পর্কে নিঁখুত ভাবে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের জন‍্য খুবই হেল্পফুল হবে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা পর্যালোচনা করো। (Review the role of Mahatma Gandhi in the freedom movement of India.)


‘সত্যাগ্রহ' তত্ত্বের প্রবক্তা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবাসীর জাতীয় আন্দোলন এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। সাধারণভাবে তিনি ‘মহাত্মা গান্ধী' নামে সমধিক পরিচিত। এই মহামানবের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের সূচনা ঘটে।


রাজনৈতিক জীবনের সূচনা:


১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দর নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়। ব্যারিস্টারি পাস করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অল্পকালের মধ্যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান এবং সেখানে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর ‘সত্যাগ্রহ’ তত্ত্ব ও পদ্ধতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি সত্যাগ্রহীদের ন্যায় ও


সত্যের প্রতি অবিচল ও আস্থাশীল থাকার আবশ্যিকতার ওপর জোর দেন। সত্যাগ্রহের মূল নীতি হল আদর্শ জীবনযাপনের অঙ্গীকার এবং যে-কোনো অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগিতা। এবং এই অসহযোগিতা হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ভারতের জাতীয় আন্দোলনে যোগদান করেন। আমেদাবাদের 'সবরমতী' নদীতীরে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে (১৯১৫ খ্রিঃ) তিনি স্বদেশপ্রেমী ভারতীয়দের সত্যাগ্রহের আদর্শ ও পদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।


জাতীয় নেতৃত্বের পূর্বাভাস:

বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগদানের পূর্বে তিনি দক্ষতার সাথে কয়েকটি আঞ্চলিক সমস্যাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল চম্পারণের কৃষক আন্দোলন। উত্তর বিহারে নীলকর সাহেবরা দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার চালাচ্ছিল। নিপীড়িত চাষীদের আহ্বানে গান্ধীজি চম্পারণে আসেন ও চাষীদের সত্যাগ্রহে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। চম্পারণের কৃষক আন্দোলনকে গান্ধীজির নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনের 'Dress Reharsal' বলে অভিহিত করা হয়। একইভাবে আমেদাবাদের সূতাকল শ্রমিক ধর্মঘট এবং গুজরাটের খেরা অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের (১৯১৮ খ্রিঃ) নেতৃত্বদান তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচির দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এইভাবে যুগপৎ শহর এবং গ্রামের শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে গণ-জাগরণ সৃষ্টি করে গান্ধীজি জাতীয় আন্দোলনের নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা করেন।


সত্যাগ্রহ আন্দোলন:


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ব্রিটিশ সরকারের ভারত- নীতিতে অত্যাচার ও স্বৈরাচারের মাত্রা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। রাওলাট আইন' জারি করে সরকার ভারতবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয়। গান্ধীজি এই সময়ে সর্বভারতীয় নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন। তিনি বড়োলাটকে এক পত্র দ্বারা ‘রাওলাট আইন' প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। কিন্তু বড়োলাট তা অস্বীকার করেন। অতঃপর তিনি সত্যাগ্রহের ডাক দেন। তাঁর নির্দেশে ১৯১৯-এর এপ্রিল মাসে একদিন সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। কোনো কোনো স্থানে রাওলাট আইন-বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে তিনি আন্দোলন স্থগিত রাখার আবেদন জানান। তিনি সত্যাগ্রহী আদর্শের পূর্ণ বিকাশের পূর্বেই আন্দেলনের এই ডাক দেওয়াকে 'Himalayan miscalculation' বলে অভিহিত করেন।


অসহযোগ আন্দোলন:


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর খিলাফৎ আন্দোলনের উদ্ভব ও গান্ধীজির যোগদান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গান্ধীজি মনে করতেন, ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ন্যায্য ও যথার্থ। তাঁকে সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে খিলাফৎ কমিটির পক্ষে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে তিনি ‘অহিংস অসহযোগ' (Non- Violent Non-Co-operation)-এর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সদ্ব্যবহার করেন গান্ধীজি। কলিকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীজি ভারতে স্বরাজ (Autonomy) প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। খিলাফৎ আন্দোলনের সাথে কংগ্রেসের আন্দোলনকে যুক্ত করে তিনি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করতে সচেষ্ট হন। কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে (১৯২০ খ্রিঃ) অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।


১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল সরকারি খেতাব প্রত্যাখ্যান, সরকারি অনুষ্ঠান বর্জন, স্কুল-কলেজ বয়কট, অফিস-আদালত বয়কট, বিদেশি দ্রব্য বর্জন ইত্যাদি। আন্দোলনের ডাক দিয়ে গান্ধীজি ঘোষণা করেন, “ভারতীয়দের ন্যায্য দাবির প্রতি উদাসীন ও হৃদয়হীন এই বিদেশি সরকারের সাথে যে-কোনো রকম সহযোগিতা করা পাপ।” যাই হোক, তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। বহু শ্রমিক ও চা-বাগিচার কৃষক আন্দোলনের শামিল হয়।

কিন্তু উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরাতে আন্দোলনকারী জনতা একটি পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে গান্ধীজি অকস্মাৎ এই আন্দোলন স্থগিত করে দেন। এজন্য তাঁর অনেক সমালোচনা হয়েছে। সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তকে 'এক জাতীয় বিপর্যয়' বলে অভিহিত করেছেন। এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সঠিক কী সম্পূর্ণ ভুল এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, এটিই ছিল ভারতবাসীর প্রথম গণ-আন্দোলন এবং গান্ধীজি যথাযথ দক্ষতার সাথেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে এই জাতীয় আন্দোলনের সামিল করতে সমর্থ হয়েছিলেন।


অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হবার অব্যবহিত পরেই গান্ধীজিকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯২৫-এর শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান। সেই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু প্রমুখ 'স্বরাজ্য' নেতাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধীজির সমর্থক-সংখ্যাই ছিল বেশি। তবুও তিনি উদারতা দ্বারা বিক্ষুব্ধ নেতাদের আপন করে নেন।


আইন অমান্য আন্দোলন:


এদিকে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও অত্যাচার অব্যাহত ছিল। ভারতবাসীকে রাজনৈতিক অধিকারদানের প্রশ্নে সরকার প্রায় নীরবই থাকে। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জাতীয় কংগ্রেস, এগোতে থাকে। অবশ্য গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি আস্থা পূর্ববৎ‍ই বহাল থাকে। ইংরেজের বিমাতৃসুলভ আচরণ ও একগুঁয়েমির ফলে কংগ্রেস ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে 'পূর্ণ স্বাধীনতা' অর্জনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। অবশ্য বলা হয়, আগামী এক বছরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন' অধিকার প্রদান করলে কংগ্রেস তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এবারেও কংগ্রেসের দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়।

এমতাবস্থায় কংগ্রেস গান্ধীজির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। লবণ আইন ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে গান্ধীজি ৭৮ জন অনুগামীসহ 'ডান্ডি অভিযান' শুরু করেন। দীর্ঘ-যাত্রাপথে তিনি দেশবাসীকে আন্দোলনে শামিল হবার আহ্বান জানান। সারা দেশে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়। মেদিনীপুর, মহারাষ্ট্র, উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি স্থানে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যাপক আকার লাভ করে। গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে এই আন্দোলন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।

আইন অমান্য আন্দোলনের তীব্রতায় চিন্তিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধীজি দ্বিতীয় গোল- টেবিল বৈঠকে যোগ দেন। কিন্তু অন্যান্য দলের সাম্প্রদায়িক দাবির ফলে এই বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে গান্ধীজি লক্ষ্য করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। এতে মর্মাহত, ক্ষুব্ধ গান্ধীজি পুনরায় আইন অমান্যের ডাক দেন।

ধূর্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে ভাঙার জন্য এই সময়ে 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা'র সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পৃথক গোষ্ঠীভূক্ত করার এই ব্রিটিশ চক্রান্তের প্রতিবাদে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত হিন্দু-বিচ্ছেদের চক্রান্ত নষ্ট করে দেন।


'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন:


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রাণস্পন্দন দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর অনুমোদন ছাড়াই ভারতবর্ষকে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ফেললে ভারতবাসী ক্ষুব্ধ হয়। কয়েক মাস রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার পর, এই সংকট মুহূর্তে গান্ধীজি আবার নেতৃত্বে ফিরে আসেন। 'হরিজন' পত্রিকায় এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে তিনি ইংরেজকে ভারত ছেড়ে যাবার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, ইংরেজ ভারতে থাকার কারণেই এদেশে জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে না। তাঁর এই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের কর্মসূচি রচিত হয়।

১৯৪২-এর ৮ই আগস্ট গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দেয়। গান্ধীজি দৃপ্তভাবে ঘোষণা করেন, “আমরা স্বাধীনতা অর্জন করব অথবা মৃত্যুবরণ করব। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে" ("We shall do or die. We shall either free India or die in the attempt. ")। ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “এখন থেকে আপনাদের প্রত্যেককে মনে করতে হবে যে, আপনারা মুক্ত..... মনে রাখতে হবে আপনারা সাম্রাজ্যবাদের পদানত নন।” আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে 'গান্ধীজি-সহ অধিকাংশ নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। মুক্তিলাভ করার পর তিনি সাম্প্রদায়িক সমস্যা মিটমাটের জন্য মিঃ জিন্নাহর সাথে আলাপ-আলোচনা চালান। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মৃত্যু:

ভারতবাসীর ন্যায্য দাবি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার এদেশে 'ক্যাবিনেট মিশন' পাঠাতে বাধ্য হন। এই মিশন গান্ধীজির সাথে দীর্ঘ আলোচনা চালান (১৯৪৬ খ্রিঃ)। ঐ সময় লিগের প্ররোচনায় কলিকাতা, বিহার, নোয়াখালিতে ব্যাপক হিন্দুনিধন শুরু হয়।

জীবন তুচ্ছ করে গান্ধীজি উপদ্রুত অঞ্চল পরিভ্রমণ করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেন। ঘটনার অনিবার্য ফলস্বরূপ ভারত-ব্যবচ্ছেদ ঘটে গান্ধীজি কখনোই তা চাননি। কিন্তু তার পরেও হিন্দু-মুসলমান সংঘাত অব্যাহত থাকলে, তা প্রশমনের উদ্দেশ্যে তিনি অনশন পালন করেন (জানুয়ারি, ১৯৪৮ খ্রিঃ)। কিন্তু ৩০শে জানুয়ারি এক প্রার্থনা-সভায় যোগদানকালে জনৈক আততায়ীর হাতে এই মহান ভারত-সন্তানের জীবনাবসান হয়।

আরও পড়ুন-
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area