Ads Area


ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ নিয়ে সম্পূর্ণ আলোচনা | Indian Schools of Philosophy PDF

ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ | Indian Schools of Philosophy PDF


ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ নিয়ে সম্পূর্ণ আলোচনা | Indian Schools of Philosophy PDF


ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ (Indian Schools of Philosophy) PDF- কলিকাতা ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের Education Honours- এ দ্বিতীয় সেমিস্টারের দুটি Core Course- এর একটি টপিকটি থেকে ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।



ভারতীয় দর্শনের শাখাসমূহ (Indian Schools of Philosophy)



ভারতীয় দর্শন মূলত আধ্যাত্মিক (Spiritual) এবং ব্যাবহারিক সত্যের উপলব্ধির (Practical realisation of truth) উপর প্রতিষ্ঠিত। সত্যদর্শন বা সত্যের উপলব্ধি ভারতীয় দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে সত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন ভারতীয় দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, বরং কীরূপে সত্যকে আশ্রয় করে সংযত, মার্জিত ও মুক্ত জীবনযাপন করা যায় -এই ব্যাবহারিক দিকটিও ভারতীয় দর্শনের মধ্যে কমবেশি নিহিত। বস্তুত শুধু জ্ঞানলাভই নয়, পরমার্থ লাভের জন্য জীবনচর্যা নির্বাহ করাও ভারতীয় দর্শনের উদ্দেশ্য। ভারতীয় দর্শনে প্রধানত আত্মজ্ঞান বা আত্মার উপলব্ধির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিই ভারতীয় দর্শনে প্রাধান্য লাভ করেছে।

এই দর্শন হল এক আধ্যাত্মিক অনুভব, এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যা আত্মচেতনায় প্রকাশ পায়। ভারতীয় দর্শন বলতে বেদপন্থী, বেদবিরোধী, ঈশ্বরবিশ্বাসী, ঈশ্বর অবিশ্বাসী, আধ্যাত্মিক ও জড়বাদী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার দার্শনিক চিন্তাকে বোঝানো হয়েছে।

একদিকে যেমন বেদপন্থী ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ, মীমাংসা-বেদান্ত প্রভৃতি দর্শন চিন্তা ভারতীয় শিক্ষাদর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে বেদবিরোধী চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন চিন্তা ভারতীয় শিক্ষাচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। ভারতীয় দর্শন বহু শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত।

বিভিন্ন ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন মতাদর্শ পরিলক্ষিত হয়। আবার মতাদর্শগুলি বিরুদ্ধভাবাপন্নও মনে হয়। কিন্তু এ বিরোধ আপাত, প্রকৃত বিরোধ নয়। আসলে ভারতীয় দর্শনের সকল শাখাপ্রশাখাকে পরম উপলব্ধির বিকল্প ব্যাখ্যা (Alternative explanations) বলা যায়।


ভারতীয় দর্শনের সাধারণ ধারণা (Common Ideas of Indian Philosophy)



ভারতের বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির কতকগুলি সাধারণ ধারণা (Common ideas) পরিলক্ষিত হয়। প্রধান ধারণাগুলি নীচে বর্ণনা করা হল-

1. আধ্যাত্মিক ও ধর্মভিত্তিক (Spiritual and Religious):

চার্বাক ছাড়া ভারতীয় দর্শন মূলত আধ্যাত্মিক (Spiritual), ধর্মভিত্তিক (Religious)। অধ্যাত্ম নীতি ও ধর্ম ভারতীয় দর্শনের মূলভিত্তি। দর্শন ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। আত্মাকে দেখো (See thyself) সকল দর্শন সম্প্রদায়ের মূলমন্ত্র। ড. রাধাকৃষ্ণণ বলেন- ভারতীয় দর্শন স্বরূপত আধ্যাত্মিক।


2. আত্মার স্থায়িত্বে বিশ্বাসী (Permanence of Self):

ভারতীয় দর্শনে বিশ্বজগৎ অনিত্য, শুধু জীবের মধ্যস্থ আত্মা অবিনশ্বর ও শাশ্বত। চার্বাক ও বৌদ্ধদর্শন ছাড়া ভারতীয় ষড়দর্শন সাধারণত আত্মার স্থায়িত্বে বিশ্বাসী।


3. কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ (Law of Karma and Rebirth):

চার্বাক ছাড়া অন্যান্য সব ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় এক সর্বব্যাপী নৈতিক নিয়মে বিশ্বাস করে। এই নৈতিক নিয়মের জন্যই মানুষ যা কর্ম করে তার ফল অবশ্যই ভোগ করবে। এই তত্ত্বকেই কর্মবাদ বা Law of Karma বলা হয়। শাশ্বত, চিরন্তন আত্মা কর্মফল অনুসারে দেহ ধারণ করে এবং কর্মফল ভোগ করে। ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত কর্মবাদের সঙ্গে জন্মান্তরবাদের বিশ্বাসও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। 
অবিদ্যার নাশ এবং নিষ্কাম কর্মের দ্বারা মানুষ পুনর্জন্মের হাত থেকে রেহাই পায়।


4. আত্মোপলব্ধি (Self-realization):

আত্মোপলব্ধি ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা আত্মার উপলব্ধি ঘটে। আত্মানং বিধি -এই আত্মোপলব্ধির মধ্যেই ভারতীয় দর্শনের পরম সত্য নিহিত। এই আত্মা এক আধ্যাত্মিক সত্তা, কোনো জড় দ্রব্য নয়, একথা চার্বাক ছাড়া আর সকল ভারতীয় দর্শনেই স্বীকার করা হয়েছে।


5. দুঃখ বা নৈরাশ্যবাদ (Pessimism):

চার্বাক ছাড়া অন্যান্য সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় জগৎকে দুঃখময় বলে মনে করেন। বুদ্ধদেব বলেছেন- সবই দুঃখময়। সাংখ্যদর্শনে দুঃখের প্রাধান্য বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে। তবে শুরুতে দুঃখের কথা বললেও দুঃখ নিবৃত্তি ও দুঃখ নিবারণের উপায়ের কথাও বলা হয়েছে। মোক্ষ বা নির্বাণলাভ দুঃখের বিনাশ ঘটায়। সুতরাং দুঃখের উপর গুরুত্ব দিলেও ভারতীয় দর্শনকে দুঃখবাদী বা নৈরাশ্যবাদী দর্শন বলা যায় না।


6. বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য (Unity in Diversity):

ভারতীয় দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা হল -এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক অখণ্ড সত্তা। আর এর মূলে রয়েছেন। এক সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ল। তিনি এই বিশ্বজগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের নিয়ন্তা। এই সৃষ্টি বৈচিত্র্যময়। আর এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতীয় দর্শনের মূল নির্যাস।


7. মোক্ষই পরম পুরুষার্থ (Liberation is Ultimate Reality):

মানুষের কাম্যবস্তুকে পুরুষার্থ বলা হয় । আর মোক্ষ হল দৈহিক বন্ধন থেকে আত্মার মুক্তি ও পূর্ণতার অবস্থা।

ভারতীয় দর্শনে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ -এই চার প্রকার পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে। চার্বাক ছাড়া অন্যান্য সব দার্শনিক সম্প্রদায়ই মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করেন। মোক্ষকে জীবনের শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধরূপে গণ্য করা হয় (Moksha is the highest value of life)।

বৌদ্ধদর্শনে মোক্ষকে বলা হয় নির্বাণ বা দুঃখের চিরবিলুপ্তি। ন্যায়, মীমাংসকদের মতে আত্মার স্বরূপে অবস্থানই মোক্ষ। যোগদর্শনেও আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধিই মোক্ষ নামে অভিহিত। তাই অনেক সময় ভারতীয় দর্শনকে মোক্ষশাস্ত্রও বলা হয়।

মোক্ষলাভ হলে পুনর্জন্ম হয় না। সকল দুঃখকষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটে। আধ্যাত্মিকতা ভারতীয় দর্শনের প্রাণস্বরূপ। অধ্যাত্মসাধনাই পরম সাধনা। তাই ভারতীয় ঋষির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়। অর্থাৎ আমাকে অসৎ থেকে সৎ -এ নিয়ে চলো, অন্ধকার থেকে আলোতে, মৃত্যু নয়- অমৃতলোকে নিয়ে চলো।



দর্শন ও শিক্ষা (Philosophy and Education)



দর্শন ও শিক্ষা পরস্পর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভারতীয় দর্শনের মৌলিক তত্ত্বসমূহ এবং তাদের শিক্ষাগত তাৎপর্য আলোচনা আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দর্শন ও শিক্ষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরেই শিক্ষাদর্শন (Educational Philosophy) গড়ে উঠেছে। দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে ও কালে প্রখ্যাত দার্শনিকেরা শিক্ষাভাবনারও প্রবক্তা ছিলেন। 

প্রাচীন ভারতভূমিতে বেদ-উপনিষদের যুগে আত্মমুক্তি বা পরাবিদ্যাকে শিক্ষার পরম লক্ষ্য (Ultimate aim of Education) রূপে অভিহিত করা হয়েছে।

আবার, ব্যাবহারিক জীবনে অপরাবিদ্যাকে আপাত শিক্ষার লক্ষ্য (Proximate aim of Education) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।





2.1. সাংখ্য দর্শন (Samkhya Philosophy)


সাংখ্যদর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম একটি শাখা। শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, মহাভারত, উপনিষদ- সর্বত্রই সাংখ্যদর্শনের উল্লেখ আছে। সাংখ্যদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি কপিল।

গীতা, ‘সাংখ্য’ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে একাধিক মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘সংখ্যা’ কথাটি থেকে ‘সাংখ্য’ শব্দটির উৎপন্ন হয়েছে। তাঁদের মতে , তত্ত্ব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করার জন্য জ্ঞানের তত্ত্ব-সংখ্যা সম্বন্ধে অবগত হওয়া দরকার। আবার অনেকে বলেন, ‘সাংখ্য’ কথাটির অর্থ সম্যক জ্ঞান। যে দর্শনে সম্যক জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেই দর্শন যথার্থই সাংখ্যদর্শন।

সাংখ্যদর্শনে তত্ত্বসংখ্যা পঁচিশ (পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব)। তবে, যে দুটি মূল তত্ত্ব সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত, সেগুলি হল- প্রকৃতি ও পুরুষ। তাই সাংখ্যদর্শনকে দ্বৈতবাদী বলা হয়। সাংখ্যমতে, পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব এই দুই মূল তত্ত্বের (প্রকৃতি ও পুরুষ) অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি ও পুরুষ ছাড়া আরও দুটি তত্ত্বের উল্লেখ করা যায় সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্বে। সে দুটি হল- প্রকৃতি-বিকৃতি এবং বিকৃতি।


2.1.1. সাংখ্যমতে প্রকৃতি ও তার গুণ (Prakriti and Gunas in Sāmkhya System)

i. প্রকৃতিতত্ত্ব হল সাংখ্যদর্শনের প্রথম মূল সূত্র। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মিকা। সাংখ্যদর্শনে জগতের আদি ও উপাদান কারণ হল প্রকৃতি। প্রকৃতি সকল কার্যের কারণ, কিন্তু নিজে অকারণ (Uncaused)। স্বভাবতই প্রকৃতি কোনো কারণের কার্য হতে পারে না। তাই প্রকৃতি হল অধিকৃতি। প্রকৃত সূক্ষ্ম, নিত্য, সর্বব্যাপী ও পরিণামশীল জড় সত্তা।

ii. সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতিতত্ত্ব পরিণামবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে মতবাদে কার্যকে কারণের পরিণাম মাত্র বিবেচনা করা হয়, সেই মতবাদকে পরিণামবাদ বলা হয়। সাংখ্যমতে, এই জগৎ ও জগতের যাবতীয় বস্তুর মধ্যে কার্যের লক্ষণ দেখা যায়। অর্থাৎ জগৎ হল কার্য যা কোনো কারণ থেকে সৃষ্ট।

এই জগরূপ কার্য অব্যক্ত শক্তি রূপে কারণের মধ্যে নিহিত থাকে। সাংখ্যদর্শনে, এই শক্তি হল জগতের আদি ও উপাদান কারণ -আর এই কারণ হল প্রকৃতি। সুতরাং প্রকৃতির অব্যক্ত শক্তির ব্যক্ত রূপ বা পরিণাম হল এই জগৎ ও জগতের যাবতীয় বস্তু।

iii. সাংখ্য দার্শনিকরা মনে করেন, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থা হল প্রকৃতি। সাংখ্যমতে, এই তিনটি গুণ প্রকৃতির স্বরূপ বা উপাদান, প্রকৃতিতে আশ্রিত কোনো ধর্ম নয়। প্রকৃতির এই গুণত্রয় পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জগতের সকল বস্তু গঠন করে। সকল জাগতিক বস্তুর মধ্যে তিনটি গুণ দেখা যায়, যেমন- সুখ, দুঃখ এবং ঔদাসীন্য। কোকিলের গান শুনে শিল্পী আনন্দ পায়, কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তির কাছে সেই গান পীড়াদায়ক মনে হতে পারে। আবার গ্রাম্য চাষির মনে তা সুখ বা দুঃখ কোনো অনুভূতিই জাগাতে পারে না।

সাংখ্য দার্শনিকরা সুখ, দুঃখ ও ঔদাসীন্য -এই তিনটি গুণ বা উপাদানকে যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ বলেছেন।

iv. সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতির এই গুণ তিনটি সর্বদাই পরিণামশীল বা পরিবর্তনশীল। এই গুণ তিনটি যখন কেবল নিজ নিজ স্বরূপের মধ্যে পরিবর্তিত হয়, তখন কোনো একটি গুণ অন্য গুণকে প্রভাবিত করে না। তিনটি গুণের এই স্বরূপ। পরিবর্তন হল গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা। সাংখ্যমতে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতি। এই অবস্থায় প্রকৃতি থেকে কোনো দ্রব্যের সৃষ্টি হয় না। কারণ এই অবস্থায় কোনো গতি বা ক্রিয়া থাকে না। আবার বস্তু সৃষ্টিকালে এই গুণ তিনটি ক্রিয়াশীল হয় এবং একটি গুণ অপর দুটি গুণের উপর প্রভাব বিস্তার করে ও প্রাধান্য লাভ করে।

প্রকৃতির উপরোক্ত গুণ তিনটি জাগতিক প্রতিটি বস্তুর উপাদান, আবার প্রকৃতিরও উপাদান।

উল্লেখযোগ্য যে, সাংখ্যমতে প্রকৃতির পরিণাম নিছক অন্ধ ও উদ্দেশ্যহীন জড়শক্তির ক্রিয়ামাত্র নয়। পুরুষের ভোগ ও মোক্ষলাভই হল প্রকৃতির পরিণামের উদ্দেশ্য। এই বিশ্বচরাচর প্রকৃতির পরিণাম স্বরূপ, তাই প্রকৃতি বিশ্বচরাচরের কারণ। কিন্তু প্রকৃতি স্বয়ম্ভূ, প্রকৃতি কোনো কারণের পরিণাম নয়। প্রকৃতি কোনো কিছু থেকে উৎপন্ন নয় বলে প্রকৃতির বিনাশ নেই। অব্যক্ত প্রকৃতি সৃষ্টিতে ব্যক্ত বা বিকশিত।


2.1.2. পুরুষ বা আত্মা (Purusa or Self)

সংখ্যদর্শনের দ্বিতীয় মূল সূত্র হল পুরুষ বা আত্মা। পুরুষ কারণ (প্রকৃতি) নয়, তাবার পুরুষ কার্যও (বিকৃতি) নয়। পুরুষ অনুভয়রূপ। Purusa is neither prakriti nor vikriti (Anubhoyrup) পুরুষ চিৎ- স্বরূপ, আনন্দময়, সচেতন, অপরিবর্তনীয় ও নিষ্ক্রিয়। পুরুষ বা আত্মাকে কখনোই দেহ-মন-বুদ্ধির সঙ্গে এক করা যায় না।

i. সাংখ্যমতে, প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে আত্মা আছে। যে দেহে আত্মা থাকে, সেই দেহের প্রকৃতি অনুসারে আত্মার স্বরূপ প্রকাশিত হয়। সাংখ্যদর্শনে আত্মার বহুত্ব স্বীকার করা হয়েছে।

ii. সমস্ত প্রকার সুখ-দুঃখ-মোহের অনুভূতি থেকে মুক্ত পুরুষ বা আত্মা হল জ্ঞাতা; আত্মা কখনোই জ্ঞানের বিষয় হয় না।

iii. পুরুষ স্বরূপত শুদ্ধ চৈতন্য। পুরুষের কোনো বিকার বা পরিণাম নেই। নির্বিকার বা অপরিণামী পুরুষ বা আত্মা নিষ্ক্রিয়। তার উৎপত্তি নেই, তাই বিনাশও নেই। পুরুষ নিত্য ও সনাতন।

iv. পুরুষ মন নয়, প্রাণ নয়, দেহ নয়- পুরুষ হল আত্মা যা শান্ত, স্থির ও অনন্ত এবং যা বস্তুত প্রাণ-মন-দেহকে ধারণ করে।

v. সকল ক্রিয়া ও পরিবর্তনের অতীত হল পুরুষ বা আত্মা- যা নিষ্ক্রিয় ও নির্বিকার দ্রষ্টা।

vi. আত্মা স্বরূপত নিত্য, শূদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত। মুক্ত স্বভাব বলে আত্মার বন্ধন স্বাভাবিক নয়; তাই আত্মা স্বরূপত সুখ-দুঃখের অতীত। কিন্তু অজ্ঞানতার বশে আত্মা যখন দেহ, মন, বুদ্ধি ও অহংকারের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন করে সর্বপ্রকার কর্ম সম্পাদন করে, তখন তা সুখ-দুঃখের অধীনস্থ হয়। এই অবস্থায় পুরুষ বুদ্ধিজাত সুখ-দুঃখকে আত্মগত বলে মনে করে। ফলত আত্মা বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়।




2.1.3. প্রকৃতি-বিকৃতি (Prakriti-Vikriti) ও বিকৃতি (Vikriti)

সাংখ্যদর্শনে দুটি মূল তত্ত্ব হল প্রকৃতি ও পুরুষ। এই দুই মূল তত্ত্ব ছাড়া প্রকৃতি-বিকৃতি ও বিকৃতি -এই দুই তত্ত্বও সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত।

প্রকৃতি-বিকৃতি:

যা কারণ ও কার্য উভয়ই, তা হল প্রকৃতি-বিকৃতি। প্রকৃতি-বিকৃতির অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলি একদিকে যেমন তাদের পরিণামের (Effect) কারণ বা প্রকৃতি (Cause), অন্য দিকে সেগুলি আবার কারণ (Cause) থেকে উৎপন্ন বলে কার্য (Effect) বা বিকৃতি। মহৎ বা বুদ্ধি (Intellect), অহংকার (Ego), পঞ্চতন্মাত্র অর্থাৎ রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ (Panchatanmātra) -এই সাতটি উপাদান সাংখ্যমতে প্রকৃতি- বিকৃতি।

বিকৃতি:

যা কেবল কার্য (Effect), তা হল বিকৃতি। অর্থাৎ বিকৃতির অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলি কোনো কার্যের কারণ নয়, কিন্তু এগুলি কারণ থেকে উৎপন্ন বলে কার্য (Effect) বা বিকৃতি। মন, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক), পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (বাক, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ), পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ্, তেজস্, মরুৎ ও ব্যোম বা আকাশ) -এই ষোলোটি উপাদান সাংখ্য মতে বিকৃতি।


2.1.4. সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব (Samkhya Panchabingsati Tattva)

সাংখ্যমতে, পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের দুটি মূল তত্ত্ব হল প্রকৃতি ও পুরুষ। এ ছাড়া, প্রকৃতি বিকৃতি ও বিকৃতি -এই দুই তত্ত্ব জগতের বিভিন্ন পদার্থের পত্তি ও অভিব্যক্তির ঘটনাক্রমে থাকে বলে এই দুটিও সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি থেকে জগতের সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের ধারাটি নিম্নরূপ-

i. প্রথমে প্রকৃতি থেকে মহৎ বা বুদ্ধি (Intellect) উৎপন্ন হয়। এটি জগৎ সৃষ্টির বীজ। প্রকৃতির অন্তর্গত সত্ত্বঃগুণের প্রাধান্যে বুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। বুদ্ধির কাজ হল নিজেকে ও অপর কিছুকে প্রকাশ করা। 

ii. বুদ্ধি থেকে অহংকারের সৃষ্টি। অহং (Ego) কেন্দ্রিক লক্ষণ, যেমন অভিমান, মায়া, মমত্ববোধ ইত্যাদি অহংকারের বৈশিষ্ট্য। উল্লেখযোগ্য যে, এই অহংকারের বশে আত্মা বা পুরুষ তার স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে। আত্মা তখন ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য নানা কর্ম সম্পাদন করে। এইভাবে, অহংকার ও বুদ্ধিবিশিষ্ট আত্মা বা পুরুষ সংসারে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়।

iii. অহংকারের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের প্রাধান্য অনুযায়ী যথাক্রমে সাত্ত্বিক অহংকার, রাজস্ অহংকার এবং তামস্ অহংকারের উদ্ভব হয়। বাচস্পতি মিশ্র-র মতে, সাত্ত্বিক অহংকার থেকে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, যথা–চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক উৎপন্ন হয়। তাঁর মতে, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা- বাক, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ এবং মনেরও উৎপত্তি ঘটে সাত্ত্বিক অহংকার থেকেই।

iv. তামস গুণ থেকে পঞ্চতন্মাত্র, যেমন- রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ উৎপন্ন হয়। পঞ্চতন্মাত্র থেকে আবার পাঁচটি মহাভূত, যেমন- ক্ষিতি, অপ, তেজস্, মরুৎ ও আকাশের উৎপত্তি। সত্ত্বগুণ ও তমোগুণকে সক্রিয় ও গতিশীল রাখে রজোগুণ।

v. মন হল সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র। সব ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মন যুক্ত হতে পারে। মনের অনুপস্থিতিতে কোনো জ্ঞান আহরণ করা যায় না। মন, বুদ্ধি ও অহংকারকে একত্রে অন্তঃকরণ বলা হয়।

সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের সর্বশেষ তত্ত্ব পুরুষ বা আত্মা- যা বিবর্তনের পরিণাম নয়।


2.1.5. পুরুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধ (Relation Between Purusa and Prakriti)

i. তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে সাংখ্যদর্শনকে দ্বৈতবাদী বলা হয়, কারণ এই দর্শনে প্রকৃতি ও পুরুষকে দুটি মূল তত্ত্ব হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে।

ii. সাংখ্যমতে, পুরুষ ও প্রকৃতি স্বরূপত ভিন্ন হলেও উভয়ের মিলন ও সংযোগের ফলে জগতের আবির্ভাব ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, প্রকৃতি তার স্বভাববশত সক্রিয় হলেও স্বরূপত তা জড়, অচেতন ও অবিবেকী। আবার, পুরুষ স্বরুপত চেতন হলেও তা নিষ্ক্রিয় ও অপরিণামী। তাই, প্রকৃতি বা পুরুষ এককভাবে সৃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে না। স্বভাবতই জগতের অভিব্যক্তির জন্য প্রকৃতি ও পুরুষ- উভয়ের সংযোগ অপরিহার্য।

iii. সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -প্রকৃতির এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থায় জগৎ প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত থাকে। কিন্তু প্রকৃতির এই গুণ তিনটির মধ্যেকার সাম্যাবস্থা বিনষ্ট হলে প্রকৃতি থেকে জগতের অভিব্যক্তি ঘটে। সাংখ্যমতে, পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলন পর্ব থেকেই জগতের ক্রমবিকাশের শুরু।

iv. পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগের ফলে প্রকৃতির মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়। স্বভাব চঞ্চল ও গতিশীল রজোগুণ প্রথমে বিক্ষুব্ধ হয়। এর ফলে সত্ত্ব ও তমোগুণের মধ্যে কম্পন শুরু হয় এবং এই দুটি গুণও ক্রমশ চঞ্চল ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এইভাবে গুণগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরস্পরকে প্রভাবিত করে এবং কোনো একটি গুণ অন্য দুটি গুণের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। প্রকৃতির গুণগুলির এই পরিণামের ফলে গতি ক্রিয়ার উদ্ভব হয় এবং প্রকৃতি থেকে জগতের যাবতীয় পদার্থের সৃষ্টি হয়।

v. প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই তিনটি গুণের ক্রমাগত বিশেষীকরণ ও বিভিন্ন অনুপাতে তাদের সংমিশ্রণের ফলে জাগতিক বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ সত্ত্ব রজঃ ও তমোগুণের প্রাধান্য অনুযায়ী ভিন্নধর্মী জাগতিক বস্তুগুলির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা যায়।


পরিশেষে বলা যায় যে, পুরুষ ও প্রকৃতি স্বভাবত ভিন্ন দুটি তত্ত্ব হলেও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই দুই তত্ত্বের সংযোগের অপরিহার্যতা সাংখ্যদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমত প্রকৃতি ‘প্রসবধর্মী’ বা ‘পরিণামশীল’ হলেও প্রকৃতি এককভাবে জগৎকে ব্যক্ত করতে পারে না।

সুতরাং সৃষ্টিকে ফলপ্রসূ করার উদ্দেশ্যে পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলন ঘটতেই হয়। আবার, প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের মিলন হেতু পুরুষের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এই বন্ধাবস্থা সৃষ্টি না হলে পুরুষের পক্ষে মোক্ষলাভ সম্ভব হয় না।



2.1.6. সাংখ্য কার্যকারণবাদ (Samkhy: Theory of Causation)


i. সাংখ্যদর্শনে কার্যকারণ সম্বন্ধীয় মতবাদকে সৎকার্যবাদ নামে অভিহিত করা হয়। সাংখ্য সৎকার্যবাদে কার্যের সঙ্গে উপাদান কারণের সম্বন্ধ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ii. সৎকার্যবাদে বলা হয় যে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার আগে তার উপাদান কারণের মধ্যেই নিহিত থাকে। এই মতবাদের সপক্ষে সাংখ্যদর্শনে বলা হয় যে, বিশেষ কারণ থেকে বিশেষ কার্যই উৎপন্ন হয় যেহেতু ওই বিশেষ কার্যটি তার জন্য নির্দিষ্ট উপাদান কারণেই বিদ্যমান থাকে।

অন্যথায়, যে কোনো কারণ থেকে যে-কোনো কার্য নিঃসৃত হত, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। যেমন- মৃত্তিকা থেকেই ঘট, পট ইত্যাদি উৎপন্ন হয়, দুগ্ধ থেকেই দধি, ছানা ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। আবার সূত্র থেকেই নানাবিধ বস্তু তৈরি হয়। সুতরাং একই উপাদান কারণ ভিন্ন জাতীয় কার্য উৎপন্ন করতে পারে না।

iii. সাংখ্যমতে, কার্য ও কারণ সম্পূর্ণত ভিন্ন নয়, আসলে কারণ ও কার্য স্বরূপত একই বস্তুর যথাক্রমে অব্যক্ত ও ব্যক্ত অবস্থা। কার্যের মধ্য দিয়ে কারণের বিকাশ ঘটে অর্থাৎ কারণ কার্যে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং কারণ ও কার্য উভয়ই এক, এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু অবস্থাগত। কারণে যা অব্যক্ত অবস্থায় থাকে, কার্যে তা-ই ব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, কারণ ও কার্যের ব্যাবহারিক উপযোগিতা কিন্তু ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ- মৃত্তিকা ও মৃত্তিকানির্মিত বাসন -এই দুয়ের প্রায়োগিক ব্যবহার আলাদা, যদিও এই দুয়ের উৎস পরিচয় এক।

পরিশেষে বলা যায় যে, সাংখ্যদর্শনে কার্যকারণবাদ (সৎকার্যবাদ) কারণ ও কার্য উভয়ের অস্তিত্ব বা বাস্তব সত্যতা স্বীকার করেছে। কার্যই কারণের বাস্তব পরিণাম এই মতটি সাংখ্য কার্যকারণবাদকে সহজগ্রাহ্য করেছে এবং মতবাদটিকে ব্যাবহারিক মাত্রা প্রদান করেছে।


2.1.7. সাংখ্যদর্শনে বন্ধন ও মোক্ষ (Bondage and Liberation in Sāmkhya Philosophy) ত্রিবিধ দুঃখ (Three Kinds of Pain or Suffering) আমাদের জীবন সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণ। কিন্তু বাস্তবে জীব সুখ অপেক্ষা দুঃখকষ্টই বেশি ভোগ করে। তাই দুঃখবাদই সাংখ্যদর্শনের ভিত্তি। সাংখ্যদর্শনে ত্রিবিধ দুঃখের কথা বলা হয়েছে। যেমন- আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক।

i. আধ্যাত্মিক দুঃখ (Adhyatmika):

যে সকল দুঃখ শারীরিক পীড়া ও মানসিক ভয় থেকে উৎপন্ন হয়।

ii. আধিভৌতিক দুঃখ (Adhibhautika):

যে সকল দুঃখ মানুষ, পশু ও অন্যান্য ভৌতিক দ্রব্য থেকে উৎপন্ন হয়। যেমন- জীবহত্যা, সর্পাঘাত প্রভৃতি।

iii. আধিদৈবিক দুঃখ (Adhidaivika):

ভূত, প্রেত, রাক্ষস ও দেবতা থেকে যে সকল দুঃখ উৎপন্ন হয়।

i. সাংখ্যমতে, দুঃখ পরিহার এবং সুখভোগ সকল জীবের লক্ষ্য হলেও দুঃখকে বাদ দিয়ে নিছক সুখভোগ জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ জীবদেহের সঙ্গে জরামরণাদি, দুঃখ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লিঙ্গ শরীরের নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত জীবের দুঃখভোগ অনিবার্য।

ii. ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং জীবের (Jagat, Prakriti and Purusa) বা আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়েই দুঃখের চরম সমাপ্তি ঘটে (The absolute cessation of pain is achieved through the knowledge of the nature of vyakta, avyakta and purusa)। দুঃখের পরিসমাপ্তি হল মুক্তি বা পরম পুরুষার্থ (Highest good)।





আত্মার বদ্ধাবস্থার কারণ


সাংখ্য মতাদর্শে প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের অবিবেক বা অভেদ জ্ঞানই (Non discrimination) পুরুষের বা আত্মার বন্ধনের কারণ। অবিবেকবশত পুরুষ-প্রকৃতিজাত বুদ্ধির কর্তৃত্ব ও ভোক্তত্বকে নিজের বলে মিথ্যা ধারণা করে। কিন্তু আসলে পুরুষ প্রকৃতিজাত দেহ-ইন্দ্ৰিয়-মন-অহংকার ও বুদ্ধি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকৃতি থেকে পুরুষের আত্যত্তিক নিবৃত্তিই হল মোক্ষ। আত্মা বা পুরুষ প্রকৃতি থেকে এবং প্রকৃতিজাত দেহ মন-বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয় ইত্যাদি থেকে ভিন্ন -এই উপলব্ধির মাধ্যমেই বিবেকজ্ঞান সম্ভব।

i. পুরুষ প্রকৃতি থেকে এবং প্রকৃতিজাত পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নিত্য শুদ্ধ, নিত্য মুক্ত সত্তা -এই সত্য সাক্ষাৎলাভে উপলব্ধি করতে পারলেই যথার্থ বিবেক জ্ঞান লাভ হবে। বিবেকজ্ঞান অবিদ্যা দূর করে আত্যন্তিক দুঃখ নিবৃত্তিসাধন করে। পুরুষ বা আত্মা নিত্যমুক্ত বলে বদ্ধাবস্থায় তার মুক্তির ব্যাঘাত ঘটে না। আপন মুক্ত স্বভাব ভুলে যায় মাত্র। “বুদ্ধিই অবিবেক জ্ঞান দ্বারা আত্মাকে বদ্ধ বলে প্রতীয়মান করে এবং বুদ্ধিই বিবেক জ্ঞান দ্বারা আত্মার মুক্তিসাধন করে।”

ii. আত্মার চৈতন্যের প্রতিফলন হেতু বুদ্ধিই বন্ধন ও মোক্ষ ভোগ করে। পুরুষের নিষ্ক্রিয় ও নির্বিকারভাবে স্বরূপে অবস্থান হল মোক্ষ বা অপবর্গ বা কৈবল্য। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞানের বিভেদকরণের নাম বিবেক জ্ঞান (Vivekjnana)। বিবেক জ্ঞান মোক্ষের কারণ বা কৈবল্য যা হল পরম মূল্যবোধ (Vivekjnana is the cause of Moksa or Kaivalya, which is the highest value)।

মোক্ষাবস্থায় পুরুষ বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ অবস্থান করে। এই অবস্থায় পুরুষের সুখ, দুঃখ, কর্তৃত্ব ও ভোতৃত্ব কোনো কিছুই থাকে না। সকল সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, ত্রিবিধ দুঃখের (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখের) আত্যন্তিক নিবৃত্তিই মোক্ষ (Moksa)। বেদান্তে যেমন আনন্দানুভূতির অবস্থাকে মুক্তি আখ্যা দেওয়া হয়, সাংখ্যে তা গৃহীত হয় না। সাংখ্যমতে যেখানে দুঃখ নেই, সেখানে সুখও থাকতে পারে না। কারণ সুখ ও দুঃখ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।


2.1.8. সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্ব (Samkhya Theory of Knowledge)

সাংখ্যদর্শনে মোক্ষলাভে উপযোগী জ্ঞান ছাড়াও আর-এক প্রকার ব্যাবহারিক জ্ঞানকে স্বীকার করা হয়েছে। জাগতিক বিষয়ক যে জ্ঞানের দ্বারা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার নিষ্পন্ন হয়, তাকেই ব্যাবহারিক জ্ঞান বলা হয়ে থাকে। সাংখ্যদর্শনের মতে, জ্ঞান মাত্রই সবিষয়ক। বিষয়বিহীন কোনো জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই। জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় জ্ঞেয় এবং জ্ঞানের কর্তাকে বলা হয় জ্ঞাতা। সাংখ্যমতে পুরুষই একমাত্র জ্ঞাতা হতে পারে।

পুরুষ বা আত্মার বহুত্ব সাংখ্যশাস্ত্রে স্বীকৃত একটি বিষয়। সাংখ্যমতে পরিণামী প্রকৃতির প্রথম উৎপন্ন তত্ত্ব হল মহৎ বা বুদ্ধি। প্রকৃতিজাত বুদ্ধিও প্রকৃতির ন্যায় পরিণামী ও গতিশীল। বিষয়ের সংস্পর্শে বুদ্ধির বৃত্তি হয়। যখন বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয় এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ হয় তখন বুদ্ধি বিষয়াকারে পরিণত হয়।

সাংখ্যদর্শনের মতে, বুদ্ধি দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছ ও নির্মল। ফলে বিষয়টি যে আকার বা প্রকারের হয়, বুদ্ধি বা চিত্ত সেই আকার বা প্রকার গ্রহণ করে। বুদ্ধির এইরূপ বিষয়াকার গ্রহণকে বলা হয় বুদ্ধিবৃত্তি। বিষয়াকারে আকারপ্রাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিতে যখন পুরুষ প্রতিবিম্বিত হয়, তখন আমাদের ওই বিষয়ের জ্ঞান বা উপলব্ধি হয়। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তি ও বিষয় উভয়ই জড় পদার্থ হওয়ায় চৈতন্যস্বরূপ পুরুষের প্রতিবিম্বন ব্যতীত পুরুষ বা আত্মার বোধরূপ উপলব্ধি সম্ভব নয়।

এই কারণে বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বলা হয়। সাংখ্যদর্শনে যার দ্বারা যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে ‘প্রমাণ (Source of Knowledge) বলা হয়। আর যথার্থ জ্ঞান বা উপলব্ধি হল প্রমা। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ বা প্রমাণ এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বা প্রমা বলা হয়।

সংশয়, ভ্রম বা জ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান সাংখ্যমতে প্রমাপদবাচ্য নয় কারণ সংশয় হল সন্দিগ্ধ জ্ঞান, ভ্রম হচ্ছে বিষয়-বিপরীত জ্ঞান এবং স্মৃতি হল অধিগত বিষয়ের জ্ঞান। সংশয়, ভ্রম বা স্মৃতি যাতে প্রমাণপদবাচ্য না হয়, সে কারণে অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত ও অনধিগত বিষয়ক চিত্তবৃত্তিজন্য জ্ঞানকে প্রমা বলা হয়েছে। সাংখ্যমতে, প্রমাণ তিন রকম- প্রত্যক্ষণ (Perception), অনুমান (Inference) ও শব্দ (Testimony)।


1. প্রত্যক্ষণ (Perception)

বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সাক্ষাৎ জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তাকে প্রত্যক্ষণ বলা হয়। সাংখ্যমতে পঞ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্জ কর্মেন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহংকার ও মন এইগুলি অন্তঃকরণ জ্ঞানসাম্যের কারণ।

একমাত্র পঞ্ জ্ঞানেন্দ্রিয়ই হল প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিশেষ কারণ। মন অন্তঃপ্রত্যক্ষেও বিশেষ কারণ এবং তা সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে স্বস্ব বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে তমোগুণের অভিভবপূর্বক সত্ত্বগুণের যে পরিণাম হয়, তাই প্রত্যক্ষরূপ অধ্যবসায়।

শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়াদি করণবৃত্তি কখনও যুগপৎ, আবার কখনও ক্রমশ হয়ে থাকে। ক্রমশ বৃত্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পঞ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তিকে আলোচন এবং পরবর্তী মনের বৃত্তিকে সংকল্প বলা হয়। বাচস্পতি মিশ্র ও বিজ্ঞানভিক্ষু আলোচন ও সংকল্প বৃত্তিকে যথাক্রমে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষ সদৃশ বলে বর্ণনা করেছেন।

ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর কেবল অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হয়, তাকে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। এই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণে বস্তুর কোনো বৈশিষ্ট্যকে জানা যায় না। অর্থাৎ বস্তুটি কী রকমের, এর জাতি বা নাম কী, সংজ্ঞা কী ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় না। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

অন্যদিকে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর নাম, লক্ষণ, জাতি প্রভৃতি যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞানলাভ হয়, তা হল সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ। সবিকল্পক প্রত্যক্ষণে বিশ্লেষণ, সাদৃশ্য, তুলনা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াকে প্রয়োগ করে বস্তু সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানলাভ হয়। সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে ভাষায় প্রকাশ করা যায়। সাংখ্যদর্শনে সবিকল্প প্রত্যক্ষণকে বিবেচনা ও বলা হয়।


2. অনুমান (Inference)

অনুমান হল ব্যাপ্তিজ্ঞান সম্পর্কিত বুদ্ধি। দুটি বস্তুর মধ্যে যদি নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধ দেখা যায়, তবে একটিকে প্রত্যক্ষ করে অন্যটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়, এই জ্ঞানকে অনুমানলব্ধ জ্ঞান বলা যায়। যেমন, একটি পর্বতে ধোঁয়া বা ধূম প্রত্যক্ষ করে ধারণা করা হয় যে, সেখানে আগুন রয়েছে। যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন, ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে বলে ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করে আগুনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয়।

সাংখ্যদর্শনে অনুমান তিন ধরনের হয়ে থাকে পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট। অনুমানের ব্যাপ্তি যখন কার্য-কারণ সম্বন্ধের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমরা কারণ থেকে কার্যকে অনুমান করতে পারি, এই ধরনের অনুমান হল পূর্ববৎ অনুমান।

আবার অনুমানের ব্যাপ্তি যখন কার্য-কারণ সম্বন্ধের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমরা কার্য থেকে কারণকেও অনুমান করতে পারি, এই ধরনের অনুমান হল শেষবৎ অনুমান। প্রচণ্ড খরা দেখে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের অনুমান হল পূর্ববৎ অনুমানের উদাহরণ।

আবার নদীর জলের গতিবেগ দেখে অতীত বৃষ্টির অনুমান হল শেষবৎ অনুমানের উদাহরণ। যে অনুমানের ব্যাপ্তি কার্য কারণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা যে অনুমানের হেতু ও সাধ্য কার্য-কারণ সম্বন্ধে সংবদ্ধ নয়, কেবল সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে অনুমানটি গড়ে ওঠে, সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান।

বিভিন্ন সময়ে গ্রহাদির অবস্থান বিভিন্ন স্থানে বা দেশে পর্যবেক্ষণ করে আমরা যখন গ্রহাদিও গতির অনুমান করি, তখন সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। একটি বস্তুর বিভিন্ন স্থানে অবস্থানের সঙ্গে ওই বস্তুর গতির কোনো কার্য-কারণ সম্বন্ধ নেই। কিন্তু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা গতিশীল বস্তুকে বিভিন্ন স্থানে দেখে থাকি এবং এই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা গ্রহাদিও বিভিন্ন স্থানে অবস্থান দেখে অনুমান করি যে গ্রহাদি গতিশীল। এটাই সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান।

পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট -এই তিনটি অনুমানকে সাংখ্যাচার্যরা আবার ‘বীত’ ও ‘অবীত’ ভেদে দুইভাগে ভাগ করেছেন।

i. যে অনুমান হেতু ও সাধ্যের অন্বয় সাহচর্যের ভিত্তিতে ভাবরূপে সাধ্যের সাধন করে, অর্থাৎ সদর্থক সামান্য বাক্যকে অবলম্বন করে যে অনুমান গড়ে ওঠে তাকে ‘বীত’ অনুমান বলা হয়।

ii. নঞর্থক সামান্য বাক্যকে অনুমান করে যে অনুমান গড়ে ওঠে, অর্থাৎ যে অনুমান হেতু ও সাধ্যের ব্যতিরেক সাহচর্যের ভিত্তিতে সাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু কারোর বিধায়ক না হয়ে প্রতিষেধক হয় তাকে অবীত অনুমান বলা হয়।

পূর্ববৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান হল বীত অনুমান এবং শেষবৎ অনুমান হল অর্ধীত অনুমান।


3. শব্দ (Testimony)

সাংখ্যদর্শনে তৃতীয় প্রকার প্রমাণ হল শব্দ বা আপ্তবাক্য। যে সমস্ত বিষয় বা বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা অনুমানের সাহায্যে জানা যায় না, তাদেরকে শব্দ প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। সাংখ্যমতে, যথার্থ জ্ঞানলাভ করতে হলে শব্দ বা আপ্তবাক্যের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। শব্দ বা আপ্তবাক্য হল বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপদেশ। যে বুদ্ধিবৃত্তি এই সকল জ্ঞানসাপেক্ষ প্রমার করণ হয়, তাই শব্দ প্রমাণ। সাংখ্যমতে, শব্দ প্রমাণ দু-প্রকার- লৌকিক ও বৈদিক।

লৌকিক শব্দ হল বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বাসযোগ্য লোকের বচন। লৌকিক শব্দ প্রত্যক্ষণ ও অনুমানের সাহায্যেও লাভ করা যায়। সাংখ্য দার্শনিকরা লৌকিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন না, কিন্তু বৈদিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ মানেন।

বৈদিক শব্দ হল বেদের বচন। বেদ, দেবতা, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষের অতীত এবং অনুমানের অগম্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। বৈদিক শব্দ কোনো মানুষের দ্বারা তৈরি নয়। মানুষের কৃত নয় বলে মানুষ যে জাতীয় ভুল করে সে জাতীয় ভুল বেদে থাকতে পারে না। তাই বৈদিক শব্দ অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ।


2.1.9. সাংখ্যমতে জগতের অভিব্যক্তি (Evolution of World according to Samkhya Philosophy)

সাংখ্যদর্শন পরিণামবাদে বিশ্বাসী। এই দার্শনিক মতবাদের মতে, জগৎ হল প্রকৃতির পরিণাম আর প্রকৃতি হল জগতের উৎপত্তির প্রতি উপাদান কারণ। অর্থাৎ জগৎ ও জগতের প্রত্যেক বস্তু ও বিষয়ের মূল কারণ প্রকৃতি। বলা হয়, সৃষ্টির পূর্বে জগৎ প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। এই দর্শনের মতে, পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ হওয়ার ফলে জগতের অভিব্যক্তি হয়।

সাংখ্যমতে একেই জগতের সৃষ্টি বলা হয়। এই সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। সাংখ্যমতে প্রকৃতি পুরুষের অপেক্ষা করে এবং পুরুষ প্রকৃতির অপেক্ষা করে, যেহেতু উভয়ের মধ্যে উপকার্য-উপকারভাব সম্বন্ধ আছে। পুরুষ প্রকৃতির উপকার করে প্রকৃতির সার্থকতা সম্পাদন করে। পাশাপাশি প্রকৃতির স্বরূপস্থিত সুখ-দুঃখ ভোগ করে। প্রকৃতি তখন কৃতার্থ হয়। আবার প্রকৃতি পুরুষের উপকার করে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগের ফলে মহৎ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। বস্তুত প্রকৃতি একটি ক্ষণেও স্থির থাকে না। প্রতিক্ষণেই তার নিয়ত বা নিয়মিত পরিণতি হয়ে চলেছে। প্রলয়কালেও তার পরিণামপ্রাপ্তি অব্যাহত থাকে। কিন্তু ওই সময়ে প্রকৃতির স্বরূপভূত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণের তারতম্য হয় না বলে ওই পরিণামের ফলে অন্য কোনো তত্ত্ব প্রকাশিত হয় না।

এই জন্য এই পরিণামকে বলা হয় স্বরূপ পরিণাম। কিন্তু যখন সৃষ্টির সময় উপস্থিত হয়, অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটলে প্রকৃতির মধ্যে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে রজঃ সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া শুরু হয়। রজোগুণ চঞ্চল বলে প্রথমে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরে সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া শুরু হয়।

সৃষ্টির সময় প্রকৃতির স্বরূপভূত তিনটি গুণের তারতম্য হওয়ায় যে পরিণাম হয়, তাকে বলা হয় বিরুপপরিণাম। প্রকৃতির প্রথম বিরূপপরিণাম হল মহত্তত্ত্ব। প্রকৃতির প্রথম পরিণাম যে মহত্তত্ত্ব, এই মহত্তত্ত্বেরই নামাত্তর হল মহান, বুদ্ধি ইত্যাদি।

মহৎ থেকে অহংকার উৎপন্ন হয়। অহংকার হল প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম। ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুটি বোধ অহংকারের প্রধান লক্ষণ। মহৎ -এর মতো অহংকারও ত্রিগুণাত্মক। তবে সাংখ্যশাস্ত্রে অহংকারের অন্তর্গত ত্রিগুণের পৃথক পৃথক নামকরণ করা হয়েছে। এ থেকে অহংকার তিনপ্রকারও বলা যায়।

অহংকারে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য ঘটলে সাত্ত্বিক অহংকার, রজোগুণের আধিক্য ঘটলে রাজসিক অহংকার এবং তমোগুণের আধিক্য ঘটলে তামসিক অহংকারের সৃষ্টি হয়। সাংখ্যমতে, অহংকারের সাত্ত্বিকভাগকে বৈকারিক বা বৈকৃত, রাজসভাগকে তৈজস এবং তামসভাগকে ভূতাদি বলা হয়েছে। সাংখ্যমতে অহংকার থেকে ষোলোটি উপাদান উৎপন্ন হয়। সাত্ত্বিক অহংকার থেকে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্জ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং হাত, পা, পায়ু, মুখ ও উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় এই পঞ্জ কর্মেন্দ্রিয় ও মনের আবির্ভাব হয়।

আর তামসিক অহংকার থেকে উদ্ভব হয় পঞ্চতন্মাত্রের (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ)। একাদশ ইন্দ্রিয় মন হল উভয়াত্মক। মন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কার্যের যেমন সহায়ক হয়, কর্মেন্দ্রিয়ের কার্যেরও সহায়ক হয়।

অর্থাৎ মনের সাহায্য না পেলে জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে না। আবার মনের সাহায্য না পেলে কর্মেন্দ্রিয়ও কর্মসাধনে সমর্থ হয় না। সাংখ্যকারিকায় ইন্দ্রিয়গুলির বৃত্তি বা কার্য সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। পঞ জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ উপলব্ধি করে থাকে।

আর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা- হাত, পা, পায়ু, মুখ ও জননেন্দ্রিয়ের বৃত্তি হল গ্রহণ, গমন, ত্যাগ, কথন ও জনন প্রত্যক্ষ করা। সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয় বলতে ইন্দ্রিয়ের অন্তঃস্থিত অপ্রত্যক্ষ শক্তিকে বোঝায়। প্রত্যক্ষগোচর শরীরের বহির্দেশে অবস্থিত ইন্দ্ৰিয়গুলি বোঝায় না।

সাংখ্যমতে তামসিক অহংকার থেকে পঞ্চতন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চতন্মাত্র পাঁচ রকমের অনুভূতি, যথা- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ -এর সূক্ষ্ম উপাদান। তন্মাত্রগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাই তাদের প্রত্যক্ষ করা যায় না।

কিন্তু তাদের অস্তিত্বকে অনুমান করা যায়। পঞ্চতন্মাত্র থেকে পঞ্চমহাভূত যথা- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম বা আকাশের সৃষ্টি। পঞ্চতন্মাত্র থেকে যে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি হয়, সাংখ্যদর্শনে এর একাধিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। প্রচলিত ব্যাখ্যানুযায়ী সাংখ্য দার্শনিকরা বলেন, শব্দতন্মাত্র থেকে ব্যোম বা আকাশ, শব্দতন্মাত্র ও স্পর্শতন্মাত্র থেকে মরুৎ বা বায়ু, শব্দ-স্পর্শ-রূপ তন্মাত্র থেকে তেজ, শব্দ- স্পর্শ-রূপ-রস তন্মাত্র থেকে অপ্ বা জল এবং শব্দ-স্পর্শ-রূপ-সি-গন্ধ তন্মাত্র থেকে ক্ষিতি বা পৃথিবী উৎপন্ন হয়।




সাংখ্যমতে সৃষ্টিকে সর্গ বলা হয়েছে। সর্গ দু-প্রকার যথা- প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সৰ্গ এবং তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গ। প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সর্গের অন্তর্গত বিষয়গুলি হল মহৎ, অহংকার, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, পথ্য কর্মেন্দ্রিয় ও উভয়েন্দ্রিয় মন। আর তমাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গের অন্তর্গত বিষয়গুলি হল পঞ্চতন্মাত্র ও পঞমহাভূত। পঞ্চতন্মাত্র অতীন্দ্রিয় বলে তা ‘অবিশেষ’ নামে পরিচিত।

অন্যদিকে পঞ্চমহাভূত ও তাদের দ্বারা সৃষ্টি দ্রব্যগুলিকে বিশেষ বলা হয়। সাংখ্যমতে সৃষ্টি বলতে প্রলয়ের পর প্রথম সৃষ্টি বোঝানো হয়। সৃষ্টির পরে প্রলয় হয় এবং প্রলয়ের পর সৃষ্টি হয়। এইভাবে এই প্রবাহ অনাদিকাল থেকে চলে আসছে।

প্রলয়ের পর যখন সৃষ্টি আরম্ভ হয়, তখন সূক্ষ্মশরীর নির্মিত হয়। তখন হতে আরম্ভ করে মহাপ্রলয় পর্যন্ত এই সূক্ষ্মশরীর বর্তমান থাকে। বস্তুত সাংখ্যদর্শনের অভিব্যক্তিবাদ সৎকার্যবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই এই মতে উৎপত্তি নতুন কোনো সৃষ্টি নয়, কেবল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া।

আবার বিনাশ কখনোই পরিপূর্ণ বিনাশ নয়, কেবল ব্যক্তের অব্যন্তে বিলীন হওয়া। সাংখ্যমতে প্রকৃতির জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য দ্বিবিধ- পুরুষের ভোগ এবং পুরুষের মুক্তি। যদিও পুরুষ স্বরূপত ভোক্তা নয়, তবুও বুদ্ধি বা মহৎ স্বগত সুখ এবং দুঃখরূপ ভোগকে পুরুষে প্রতিবিম্বিত করে। এইভাবে পুরুষে ভোকৄত্ব উৎপন্ন হয়।

আবার পুরুষ এবং প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি উৎপন্ন করেও প্রকৃতি পুরুষের মুক্তিসাধন করে। অর্থাৎ প্রকৃতির সৃষ্টির ফলে পুরুষ ভোগ করে। এবং পুরুষের ভোগের ফলে পুরুষের মুক্তি বা কৈবলা সম্ভব হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতির সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যমূলক বলা যায়। এই অভিব্যক্তি প্রক্রিয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।

অপরিণামী পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতির তত্ত্বের সাহায্যে সাংখ্য দার্শনিকরা এভাবেই জগতের অভিব্যক্তি বর্ণনা করেছেন।



2.1.10. সাংখ্যদর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য (Educational Implications of Sāmkhya Philosophy)



আধুনিক কালে শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল, শিক্ষাকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক এবং লৌকিক ও আধ্যাত্মিক -এইসব দিক থেকে সার্থক করে তোলা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি এ সাংখ্য সৎকার্যবাদ, পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং জীবের বন্ধন ও মুক্তি বিষয়ক ধারণাগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।


i. কারণ ও কার্যের সম্বন্ধ বিষয়ে সাংখ্য সৎকার্যবাদ বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রযোজ্য। সৎকার্যবাদ অনুযায়ী কারণের মধ্যে কার্য অব্যক্ত বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই সুপ্ত সম্ভাবনার বিবর্তন ঘটে, যাকে আমরা কার্য বলি।

সাংখ্যদর্শনের এই তত্ত্বটির সঙ্গে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা সম্পর্কীয় ধারণার সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। আধুনিককালে প্রায় সকল শিক্ষাবিদ একটি বিষয়ে একমত যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই তার বিকাশের সকল সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যথার্থ শিখন প্রক্রিয়ার সাহায্যে মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা, গুণাবলি, ক্ষমতা ও প্রবণতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। জীবনব্যাপী কিছু ‘হয়ে ওঠার’ মধ্যে দিয়েই শিক্ষা চলমান ও গতিশীল থাকে। মানুষের সকল পরিণামের (কিছু হয়ে ওঠার) যে বীজ তার নিজের মধ্যেই থাকে, তাকে উপযুক্ত পরিবেশে ও প্রতিনিয়ত চর্চার মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ দেওয়াই আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য। স্বভাবতই শিক্ষার এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাংখ্য সৎকার্যবাদের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।

ii. সাংখ্য সৃষ্টিতত্ত্বের প্রথম উৎপন্ন বস্তু হল বুদ্ধি। মননশীল মানুষের পরম সম্পদ বুদ্ধি। ইন্দ্ৰিয়জাত জ্ঞান অর্জনে মন ও বুদ্ধি ব্যক্তিকে সাহায্য করে। শিখনের প্রত্যয়গুলির অনুধাবনে বিদ্যার্থীকে বুদ্ধির উপর নির্ভর করতে হয়।

iii. আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রত্যক্ষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রিয়সমূহকে জ্ঞানার্জনের প্রবেশদ্বার (Gateway of knowledge) বলে অভিহিত করা হয়। সাংখ্য শিক্ষাদর্শে ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগে বস্তুর যে ছাপ বা অনুলিপি (Impression) তৈরি হয়, সেটি মন ও বুদ্ধি পর্যালোচনা করে। বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে এবং নির্বাচন ও বর্জনের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয় সংবেদনে প্রাপ্ত বস্তুর ছাপ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উন্নীত হয়।

এই অবস্থায় শিক্ষার্থী কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয়। ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি এই দুয়ের সহযোগে শিখনের এই প্রক্রিয়া আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, সর্বাধুনিক শিশুশিক্ষায় ইন্দ্রিয় সঞ্চালন ও পরিমার্জনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রুশো, মন্তেসরি, ফ্রয়েবেল প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ ইন্দ্রিয়সমূহের সার্বিক পরিমার্জনা ও বিকাশকে শিশুশিক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন।

iv. সাংখ্য মতাদর্শে জ্ঞানলাভের তিনটি উৎসের কথা বলা হয়েছে- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ। শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই তিনটি উৎস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

v. সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত প্রকৃতি ও পুরুষ -এই দুটি মৌলিক তত্ত্ব স্বরূপত ভিন্ন। বস্তুজগতের উৎস হল প্রকৃতি, অপরদিকে পুরুষ হল আত্মা- যা জ্ঞাতা। বিদ্যার্থীকে পুরুষ ও প্রকৃতির এই মৌলিক পার্থক্য সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। কারণ এই পার্থক্য জ্ঞানের ভিত্তিতে বিদ্যার্থী জানতে পারে, জড়জগৎ ও অধ্যাত্মজগৎ এক নয়। বিদ্যার্থী বুঝতে পারে, জ্ঞান প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে দুটি বিষয়- একটি জ্ঞানের বিষয়বস্তু অর্থাৎ জ্ঞেয় বস্তু এবং অপরটি জ্ঞানের অধিকারী অর্থাৎ জ্ঞাতা। স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞেয় বস্তু এবং জ্ঞাতা স্বরূপত ভিন্ন। এই জ্ঞান না থাকলে মানুষ কখনোই দুঃখকে অতিক্রম করতে পারে না।

vi. সাংখ্যদর্শনে মোক্ষ বা মুক্তি জীবনের পরম লক্ষ্য। পুরুষ বা আত্মা যখন প্রকৃতিজাত বিষয়ের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে, তখনই জীবের বদ্ধাবস্থার সূচনা হয়। অজ্ঞানতার কারণেই মানুষ সুখ-দুঃখের অধীনস্থ হয়- যা বৃহত্তর জীবনে ও ব্যাপকতর শিক্ষায় কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়। অজ্ঞানতা থেকে মুক্তিলাভ করা শিক্ষারও লক্ষ্য। সাংখ্যমতে, বিবেক জ্ঞানের সাহায্যে অজ্ঞানতা অপসারিত হয় এবং মুক্তিলাভ সম্ভব হয়।

বিবেক জ্ঞান হল সেই জ্ঞান যার সাহায্যে মানুষের মধ্যে পার্থিব জগৎ ও আধ্যাত্মিক জগতের পৃথক বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্ট হয়। এর ফলে, শিক্ষার্থী পার্থিব জীবনের চাহিদাগুলিকে বুঝে সেগুলি পরিপূরণে সমর্থ হয়, আবার জ্ঞাতা হিসেবে আত্মার অনন্যতাকেই উপলব্ধি করতে পারে।

vii. উল্লেখযোগ্য যে, সাংখ্যদর্শনে জীবনের প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যও এই দুটি দিকের পূর্ণ প্রকাশ। বস্তুতপক্ষে, সাংখ্যদর্শনে ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তাই বস্তু, জ্ঞান এবং কর্মকে কারিকুলাম বা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ কারিকুলাম শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনের উপায়।

viii. পাঠক্রম প্রণয়নে ব্যক্তির স্বভাববৈচিত্র্য অনুসরণ করতে হবে। এই কারণে পাঠক্রম রচনায় ব্যক্তিবৈষম্য নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সক্রিয়তা, উপযোগিতা, উদ্যমশীলতা- এগুলি হল শিক্ষার অনুসৃত নীতি। পাঠক্রম রচনাকালে বিদ্যার্থীর আগ্রহকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে হবে। সাংখ্য শিক্ষাদর্শন অনুসারে, কারিকুলাম রচনায় ভাষা, সাহিত্য, সমাজবিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা, গণিত এবং পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ix. প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, যোগদর্শনের শৃঙ্খলার তত্ত্বকে সাংখ্যদর্শন গ্রহণ করেছে। বর্তমান শিশুশিক্ষায় যোগশিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাংখ্যদর্শন মূলত দ্বৈত বস্তুবাদী বা Dualistic Realism হলেও প্রকৃতিবাদের ধারণার ইঙ্গিত এই দর্শনে স্পষ্ট। তাই বর্তমান শিক্ষার ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের তত্ত্ব সাংখ্য মতাদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।


উপসংহার (Conclusion)

ভারতের অন্যান্য আস্তিক দর্শনের মতো সাংখ্যদর্শনের মুক্তিতত্ত্বের ভিত্তি হল সত্য সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান। প্রকৃত জ্ঞান অজ্ঞানতা দূর করে জীবনের নানাবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ দেখায়। আবার জ্ঞানই শিক্ষার আদর্শ। সর্বোপরি, জ্ঞানই ব্যক্তি ও সমাজের ফ্ল্যাণের ভিত্তি।

পরিশেষে বলা যায় যে, সাংখ্যতত্ত্ব থেকে আধুনিক বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ও শিক্ষাতত্ত্ব অনেক সম্পদ সংগ্রহ করতে পারে। জড়বস্তু ও সচেতনসত্তা -এই দুয়ের মিলনেই জীবনের আবির্ভাব, গতি, পরিবর্তন ও উত্তরণ। জ্ঞানে ও কর্মে এটি উপলব্ধি করলে শিক্ষা সার্থক হয় এবং জীবন যথাসম্ভব দুঃখমুক্ত হয়।
 


Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area