Ads Area


শিক্ষাদর্শনের ধারণা | Concept of Educational Philosophy PDF

শিক্ষাদর্শনের ধারণা | Concept of Educational Philosophy PDF


শিক্ষাদর্শনের ধারণা | Concept of Educational Philosophy PDF

শিক্ষাদর্শনের ধারণা | Concept of Educational Philosophy PDF- কলিকাতা ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের Education Honours- এ দ্বিতীয় সেমিস্টারের দুটি Core Course- এর একটি টপিকটি থেকে শিক্ষাদর্শনের ধারণা, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শনের শাখাসমূহ এবং মানবতার বিকাশের জন্য দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।


1.1. দর্শনের অর্থ (Meaning of Philosophy)



জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা হল দর্শন (A rational explanation of man and universe)। দর্শন জ্ঞানের একটি বিভাগ নয় (It does not denote a department of knowledge)। এটি হল সত্যের জন্য অনুসন্ধান বা Search for truth। দর্শন মনের একটি দৃষ্টিভঙ্গি (An interest or attitude of mind)। ভারতে দির্শন মানে ‘তত্ত্বদর্শন’ -চোখ দিয়ে দেখা নয়। এই দেখা হল জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করা।

দর্শনের ক্ষেত্রে জ্ঞান আংশিক হবে না- জ্ঞান হবে সামগ্রিক ও সর্বজনীন। আচরণগত দিক থেকে জ্ঞানকে প্রয়োগ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এই জ্ঞানরাশিকে প্রজ্ঞার স্তরে বোধির পর্যায়ে উত্তরিত করে জীবনচর্যা গড়ে তুলতে হবে। আসলে সামগ্রিক জীবনবীক্ষাই দর্শন।


1.1.1. দর্শনের সংজ্ঞা (Definition of Philosophy)



দর্শনের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া খুব সহজ নয়। তা ছাড়া দর্শনের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মতভেদও আছে। কারও মতে– বিশ্বজগৎ ও জীবন, অথবা তত্ত্ব বা বস্তুর যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটনই দর্শন। অনেকে বলেন- ঈশ্বর, আত্মা, অমরত্ব ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে দর্শন আলোচনা করে। কেউ বলেন, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের যুক্তিসম্মত বিচারবিশ্লেষণ দর্শনের আলোচ্য বিষয়। কেউ আবার বলেন- সামগ্রিকভাবে তত্ত্বের সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ আলোচনাই দর্শন।

প্লেটো (Plato) বলেন, “শাশ্বত ও বস্তু স্বরূপের জ্ঞানলাভ করাই দর্শনের লক্ষ্য” (Philosophy aims at the knowledge of the eternal of the essential nature of things)।

অ্যারিস্টট্ল (Aristotle) বলেন, “সত্তা স্বরুপত যা এবং এই স্বরূপের অঙ্গীভূত যেসব বৈশিষ্ট্য, তার অনুসন্ধান করে যে বিজ্ঞান তা-ই হল দর্শন” (Philosophy is the science which investigates the nature of being as it is in itself and the attributes which belong to it in virtue of its own nature)।

হেগেল (Hegel) বলেন, “শাশ্বতের, ঈশ্বরের স্বরূপের এবং ঈশ্বরের স্বরূপ থেকে নির্গত জিনিসের জ্ঞানই হল দর্শন” (Philosophy is the knowledge of that which is eternal of what God is and what flows out of his nature)।

ব্রাডলি (F H Bradley) বলেন, “দর্শন হল নিছক অবভাসের পরিবর্তে বাস্তব সত্তা জানার প্রচেষ্টা” (Philosophy is an attempt to know reality as against mere sappearance)।

কোঁৎ (Komte) বলেন, “দর্শন হল সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান” (Philosophy is the science of all sciences)।

পলসন (Polson) বলেন, “দর্শন হল সমস্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমষ্টি” (Philosophy is the sumtotal of all scientific knowledge)।

ভুন্ড (Wundt) বলেন, “ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে একটি সুসামঞ্জস্য সমগ্রতায় একীকরণই দর্শন” (Philosophy is the unification of all knowledge obtained by the special sciences in a consistant whole)।

হার্বার্ট স্পেনসার (Herbart Spencer) বলেন, “দর্শন হল পরিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান-দর্শনের সামান্যীকরণ, যা বিজ্ঞানের ব্যাপকতম সামান্যীকরণগুলিকে উপলব্ধি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করে” (Philosophy is completely unified knowledge the generalisations of philosophy comprehending and consolidating the widest generalisations of science)।

কান্ট (Kant) বলেন, “দর্শন হল জ্ঞান সম্পর্কীয় বিজ্ঞান ও তার সমালোচনা” (Philosophy is the science and criticism of cognition)।

ফিকটে (Fichte) বলেন, “দর্শন হল জ্ঞানের বিজ্ঞান” (Philosophy is the science of knowledge)।

কান্ট ও ফিকটে দর্শনকে জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি শাখা মাত্রা। তাঁদের এই সংজ্ঞা দর্শনকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করে তুলেছে। তবে এরুপ সংজ্ঞায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয়, এটা দর্শনেরই আলোচ্য বিষয়।

মারভিন (Marvin) বলেন, “দর্শন হল সত্যের প্রতি অনুরাগ-জ্ঞানের এমন পূর্ণ ভাঙার সব সত্য যার অন্তর্ভুক্ত এবং যাতে সব সত্য এক মহান অখণ্ডতা বা তন্ত্রের মধ্যে সুবিন্যস্ত” ( Philosophy is love for the truth the complete body of knowledge that includes in it all truths organised into one great system)।


মারভিন -এর এই সংজ্ঞায় দর্শনের ক্ষেত্রে সত্যলাভের গুরুত্ব যথার্থভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু সত্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে দর্শন যে সুন্দর ও শুভ নিয়েও আলোচনা করে, তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এখানে সকল সত্যের এক মহান অখণ্ডতার কথা বলা হয়েছে যা সম্ভব নয়।

ওয়েবার (Weber) বলেন, “দর্শন হল প্রকৃতি সম্পর্কে সামগ্রিক মত অন্বেষণ এবং বস্তুর সার্বিক ব্যাখ্যাদানের প্রচেষ্টা” (Philosophy is the search for a compre hensive view of nuture, an attempt at a universal explanation of things)।

ওয়েবার -এর এই সংজ্ঞায়, জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা যে দর্শনের কাজ, একথা স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মূল্যাবধারণও যে দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ একথা স্বীকৃত হয়নি। তাঁর সংজ্ঞাটি অতি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট সুতরাং এই সংজ্ঞাও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।


দর্শনের সংজ্ঞা: যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ


যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা বলেন, “দর্শন হল ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ বা সমালোচনা” (Philosophy is critique of language)।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মতে, দর্শনে এতদিন যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়, ছদ্ম-সমস্যা মাত্র (Pseudo-problem)। যেমন- দ্রব্য কী? স্ৰষ্টা কী? আত্মা কী? বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ও ভাববাদের মধ্যে কোনটি ঠিক? প্রভৃতি প্রশ্ন বা সমস্যা ছদ্ম-সমস্যা মাত্র।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা সাধারণ প্রত্যঙ্কে যা পাওয়া যায় না তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। বিধাতা, আত্মা প্রভৃতি সাধারণ প্রত্যক্ষের অতীত, সেজন্য তাঁদের মতে এগুলি অস্তিত্বহীন। সুতরাং এসব নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।



1.1.2. দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি (Origin of Philosophical Thought)



বিস্ময় থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব 427-347)-র মতে, বিস্ময় থেকে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছে। মানুষ যখন নতুন কিছু দেখে, তখন সেই বিষয়টি নিয়ে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

এই বিচিত্র জগতের বিচিত্র সুন্দর ও অদ্ভুত জিনিস দেখে মানুষ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে জানতে চায়, এদের উদ্ভব কোথা থেকে? কে এর স্রষ্টা? কোথায় এর শেষ? ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে নিজেই সে তার চারপাশের জিনিস থেকে এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। প্রাচীন গ্রিস দেশে এভাবেই সর্বপ্রথম দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। সেখানকার আয়োনিয়া নামক দ্বীপে বাস করতেন প্রাচীনতম দার্শনিক থেলিস (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক 624-546)।

তিনি দেখলেন, চারদিকেই জল, স্থল খুব সামান্য। চারদিকে এত জল দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, জল থেকেই জগতের উৎপত্তি। জলই জগতের মূল উপাদান। এভাবেই জন্ম নেয় দার্শনিক চিন্তা। এই থেলিস হলেন প্রাচীন গ্রিক দর্শনের জনক।


কৌতূহল থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি

মানুষ কৌতূহলী জীব। দেখা-অদেখা সকল বিষয়েই মানুষের রয়েছে অদম্য কৌতূহল। যা সে দেখতে পায় তা কেন ও কীভাবে হল তা জানতে চায়। যা দেখতে পায় না সে বিষয়েও তার জানার আগ্রহ অসীম। তাই মানুষ পাড়ি জমায় অতল সাগরে, সৌরমণ্ডলে এবং এর শেষ কোথায় তা জানতে চায়। মানুষের এই কৌতূহলের শেষ নেই। আর এই কৌতূহল থেকেই উদ্ভব হয় দার্শনিক চিন্তার।


সংশয় থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি

দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, বেকন থেকে আধুনিক দর্শন পর্যন্ত অনেক দার্শনিকের চিন্তাধারাই শুরু হয়েছে সংশয় থেকে। বেকন -এর মতে, দার্শনিকদের চিন্তাধারা ছিল বাইবেলকেন্দ্রিক। তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং বলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে যা সত্য বলে প্রমাণিত হবে তা-ই হবে যথার্থ সত্য।

দেকার্ডে-র দার্শনিক চিন্তাধারাও শুরু হয় সংশয় থেকে। সংশয় করতে করতে তিনি দেখলেন, সব কিছুকে সংশয় করা গেলেও যিনি সংশয় করেন তাকে সংশয় করা যায় না। কারণ, সংশয়কারী সত্তাকে সংশয় করা হলে সংশয় করার আর কেউ থাকে না। সুতরাং সংশয়কারী সত্তাকে সন্দেহাতীত সত্তা বলে স্বীকার করতে হবে।

দেকার্তে-র সমস্ত দার্শনিক চিন্তা এই সন্দেহাতীত সত্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কান্ট তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতবাদকে সংশয় করে নিজস্ব মতবাদ প্রদান করেছেন। কান্ট -এর মতে, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সমন্বয়ে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা যায়। এই ধারণা তিনি পান অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদকে সংশয় করেই। প্রয়োজনবোধ থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি জীবনে চলার পথে মানুষের নানা জিনিসের প্রয়োজন হয়।

আর এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাকে চিন্তা করতে হয়। তাই জেমস, শিলার, ডিউই প্রমুখ দার্শনিকের মতে, যে চিন্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন মেটায় সে চিন্তাই করা উচিত। দার্শনিক চিন্তা মানুষকে জীবন-পথে চলতে সাহায্য করে; বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে তাকে সঠিক পথনির্দেশ করে এবং সত্যের সন্ধানে উৎসাহিত করে। তাই বলা যায়, প্রয়োজনবোধ থেকেই দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব।


জ্ঞানপ্রীতি থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি

‘দর্শন’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল 'Philosophy' । Philosophy কথাটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ 'Philos' এবং 'Sophia' থেকে। 'Philos' শব্দের অর্থ হল অনুরাগ (loving) এবং Sophia শব্দের অর্থ হল জ্ঞান (Knowledge)। তাই Philosophy কথাটির উৎপত্তিগত অর্থ হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ।

যাদের জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা আছে তারাই দার্শনিক। এজন্যই দার্শনিক সক্রেটিস নিজেকে জ্ঞান-প্রেমিক বলে পরিচয় দিতেন।

মানুষ তার চারপাশে যা দেখে তা-ই জানতে চায়। এক্ষেত্রে সে বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজের মতো উত্তর খুঁজে বের করে, এতে সে ক্লান্ত হয় না বরং আনন্দ পায়। তাই বলা যায়, দার্শনিক চিন্তা মানুষের অন্তরের আনন্দের ব্যাপার। আর আনন্দ পায় বলেই, এটা তার স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং বলা যায়, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা বা প্রীতি থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।



জাগতিক দুঃখে মুক্তিলাভের চিন্তা থেকে দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব হয়েছে জাগতিক দুঃখ থেকে কী করে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এই চিন্তা থেকে।

চার্বাক দর্শন ব্যতীত সকল ভারতীয় দর্শনের মতে এই পৃথিবী দুঃখময়। আর এই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হল, সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবেই জীবন দুঃখময় হয়ে ওঠে। ভারতীয় দার্শনিকরা তাই প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। মুক্তি লাভের এই জ্ঞানসাধনা থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।



মরমি চিন্তা থেকেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি


মানুষ তার ধীশক্তি দিয়ে শুধু চারপাশের জিনিস নিয়েই যে চিন্তা করে তা নয়। বিচিত্র জগৎ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই; আবার এই জগতের অন্তরালে আর-এক জগৎ নিয়েও তার চিন্তা। এ জগতের স্রষ্টা কে? মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায়? সেখানে কী ঘটে? ইত্যাদি অসংখ্য প্রশ্ন তার মাথায় আসে এবং সে তার উত্তর খুঁজে বের করে। কখনও সে সন্তুষ্ট হয়, কখনও বা সন্তুষ্ট হতে না পেরে আবার নতুন করে চিন্তা করে। এই অতীন্দ্রিয় সত্তাকে নিয়ে তার যে চিন্তা তা থেকেও দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।



1.1.3. দর্শনের প্রকৃতি বা স্বরূপ (Nature of Philosophy)



শিক্ষাদর্শন দর্শনের একটি শাখা। শিক্ষা প্রক্রিয়ার সকল দিককেই শিক্ষাদর্শন প্রভাবিত করে। শিক্ষাদর্শন শিক্ষাক্ষেত্রে দর্শনের প্রয়োগশাস্ত্র। শিক্ষা ও দর্শন একে অপরের পরিপূরক। এক কথায়, সমস্ত শিক্ষাক্ষেত্রে দার্শনিক জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।

এ দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্র অলংকৃত করেছে। দর্শনের প্রধান শাখাগুলি, যেমন- জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, লজিক এবং অধিবিদ্যা শিক্ষাক্ষেত্রে তত্ত্ব গঠনে ও সার্থক প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যে-কোনো মানবসভ্যতা কোনো না কোনো শিক্ষাদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। গ্রিসের সভ্যতার মূলে ছিল সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল -এর দর্শন। বেকন -এর শিক্ষাদর্শনের ফলশ্রুতি হল ইংরেজ জাতির উন্নতি। আমেরিকার সভ্যতা-সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী বিকাশে শিক্ষা দার্শনিক এমারসন ও জন ডিউই-র বিরাট অবদান আছে।

ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ অবশ্যই তার দার্শনিক চিন্তাধারা। বৌদ্ধ-জৈন ন্যায়-বেদান্ত দর্শন ভারতীয় শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিপুল অবদান রেখেছে।


জিজ্ঞাসা থেকেই দর্শনের সৃষ্টি

এই বিচিত্র জগতের দিকে মানুষ যখনই তাকিয়ে দেখে তখনই বিস্ময়ে তার মন ভরে ওঠে। তার মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তার মনে নানারকম প্রশ্ন জাগে, এই বিশ্বের উৎপত্তি কোথা থেকে, কোথায় এর শেষ, এর কোনো স্রষ্টা আছে কিনা, থাকলে তিনি কেমন, তার স্বরূপ কী? আমি কে কোথা থেকে এলাম? ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। বিস্ময় থেকে মানুষের মনে জেগে ওঠে জানার আকাঙ্ক্ষা। 

বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চায়, তার এই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে। এভাবেই উদ্ভব হয় দর্শনের। এজন্য প্লেটো বলেছেন, “বিস্ময়ই দর্শনের জনক”। 


প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান

প্রত্যেকেইজগৎ ও জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা করে। কিন্তু এই ধারণা সবসময় যথার্থ বা সংগতিপূর্ণ হয় না দর্শনের কাজ হল, মানুষের এই সাধারণ ধারণাগুলিকে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরীক্ষা করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সুসংহত ও সঠিক জ্ঞান প্রদান করা।



তত্ত্ববিদ্যার প্রকৃতি অন্বেষণ করা 

বস্তুর স্বরূপ বা যথাযর্থ রূপ সম্পর্কে জ্ঞানদান করাও দর্শনের কাজ। দর্শনের অন্তর্ভুক্ত তত্ত্ববিদ্যা Ontology বস্তুর দুটি রূপ সম্পর্কে আলোচনা করে। একটি বস্তুর বাহ্যিক রূপ, অপরটি বস্তুর প্রকৃত আস্তর রূপ। একটি বস্তুকে আমরা যেভাবে দেখতে পাই, তা হল বস্তুটির বাহ্যিক রূপ। বস্তুর এই রূপকে বলা হয় অবভাস (Phenomenon) এবং বস্তুটির প্রকৃত রূপকে বলা হয় আন্তর সত্তা (Noumenon বা Reality)। বাহ্যরুপের অন্তরালে বস্তুর যে প্রকৃত রূপ থাকে তা জানাই তত্ত্ববিদ্যার কাজ। আকাশ যে নীল তা আমরা প্রত্যক্ষ করি- এটি হল আকাশের বাহ্যিক রূপ। আর আমরা জানি প্রকৃতপক্ষে আকাশের কোনো রং নেই- এটি হল আকাশের প্রকৃত রূপ বা আস্তর সত্তা।



দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিক ও সমন্বয়ধর্মী

দর্শন তার আলোচ্য বিষয়বস্তুকে বিচার করে এক অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রকৃতির বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে আলোচনা করে। তাই বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি খণ্ড। কিন্তু দর্শনের কাজ হল, বিভিন্ন বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলির সুষম সমন্বয়সাধন করে তারই প্রেক্ষিতে জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা।


দর্শন ও বিজ্ঞানের পার্থক্য মাত্রাগত স্বরূপগত নয়


বিশ্বজগতের বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে আলোচনা- পর্যালোচনা কালে, বিজ্ঞান কিছু ধারণা বা সত্যকে বিচার না করে স্বীকার করে নেয়। দর্শন সেগুলি পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের যৌক্তিকতা বিচার করে দেখে।

সাধারণ জ্ঞানের তুলনায় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সুসংহত ও সুসংবদ্ধ। আবার বিজ্ঞানের তুলনায় দার্শনিক জ্ঞান আরও সুসংবদ্ধ, সুসংহত ও পূর্বাপর সম্পর্কযুক্ত। দর্শন দেশ, কাল, কার্যকারণ সম্পর্ক, জড়, চেতনা, মন, বিবর্তন, স্রষ্টা, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলি বিচার করে এগুলির যৌক্তিকতা নির্ণয় করে এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এগুলির ব্যাখ্যা দেয়।



দর্শন হল জীবনের সমালোচনা

দর্শন জীবনের স্বরূপ, অর্থ ও উদ্দেশ্য নির্ণয় ও ব্যাখ্যা করতে চায়। আমাদের জীবনের মূল্যাবধারণ করা দর্শনের অন্যতম কাজ। দর্শন জীবনের পরম আদর্শ- সত্য, শুভ ও সুন্দর -এর যৌক্তিকতা ও স্বরূপ বিচার করে। তাই দর্শনকে বলা হয়, জীবনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। দর্শনের অন্যতম কাজ হল, জগতের সঙ্গে মানবজীবনের সম্পর্ক নির্ধারণ এবং বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে এমন এক সুসংবদ্ধ ধারণা দেওয়া যে ধারণার সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিগত, নৈতিক, সৌন্দর্যগত ও ধর্মসম্পর্কীয় চেতনার সংগতি থাকে। এজন্যই বলা হয়, দর্শন হল জীবনের সমালোচনা।


দর্শনের আলোচ্য বিষয় ব্যাপক ও অনন্ত

জগৎ ও জীবনের স্বরূপ জানার জন্য দর্শন পরম সত্তা, মূল্য, জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নানা মৌলিক বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করে। আর এই আলোচনায় দর্শন শুধু মৌলিক ধারণার পরিষ্করণ এবং মৌলিক বিশ্বাসের সমীক্ষণ করে না, বরং সংশ্লেষণের মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের একটি সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দেওয়ার ও মূল্যায়নের চেষ্টা করে। দর্শন শুধু তত্ত্বালোচনাতে সীমাবদ্ধ থাকে না, দর্শন। একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা দিতে। জীবন এ কারণে যে-কোনো গভীরতর বা মৌলিক জিজ্ঞাসা দর্শনের বিবেচ্য বিষয় হয়ে পড়ে।



1.1.4. দর্শনের বিষয়বস্তু (Subject Matter of Philosophy)



জগৎ, জীবন ও জ্ঞানের বিষয়ে সাধারণত আমরা যেসব ধারণা বা বিশ্বাস করি তার যৌক্তিকতা ও মূল্যাবধারণই দর্শনের কাজ। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানের সম্ভাবনা, জড়, প্রাণ, মন ও স্রষ্টার অস্তিত্ব আমরা মেনে নিলেও দার্শনিকগণ এগুলির স্বরূপ নির্ধারণের চেষ্টা করেন। বিচার করে দেখেন- আমাদের পক্ষে কতটুকু জানা সম্ভব? জ্ঞানের সীমা কী? জ্ঞানের সত্যতা কীসের উপর নির্ভর করে? জড়ের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক কী? স্রষ্টা আছেন কি? স্রষ্টার সঙ্গে জীব ও জগতের সম্পর্ক কী? ইত্যাদি।

সুতরাং দর্শনের বিষয়বস্তুর পরিসর খুবই ব্যাপক। সমস্ত বিশ্বই দার্শনিক আলোচনার বিষয়বস্তু। কেয়ার্ড (Edward Caird) বলেন, “মানুষের অভিজ্ঞতার এমন কোনো দিক নেই, সমগ্র বিশ্বসত্তার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা দর্শনের আওতার বাইরে পড়ে বা দার্শনিক অনুসন্ধান কার্য যার দিকে প্রসারিত হয় না।”

তবে দর্শন সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে তার আলোচ্য বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়। দর্শনের আলোচ্য বিষয়কে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়- অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব ও মূলবিদ্যা।


অধিবিদ্যা (Metaphysics)

দর্শনের যে শাখা দেশ, কাল, কার্যকারণ তত্ত্ব, জড়, প্রাণ, মন ও স্রষ্টার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করে তার নাম অধিবিদ্যা। অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়কে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

(ক) বিশ্বতত্ত্ব, (খ) তত্ত্ববিদ্যা ও (গ) মনোদর্শন।

(ক) বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology):

অধিবিদ্যার যে শাখায় বিশ্বজগতের পরিদৃশ্যমান দিকের অনুসন্ধান করা হয় তাকে বিশ্বতত্ত্ব বলে। দেশ, কাল, জড়, প্রাণ, কার্যকারণ তত্ত্ব, বিশ্বজগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, অর্থাৎ সৃষ্টি ও বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে এ শাখা আলোচনা করে।


বস্তুর পরিদৃশ্যমান বা বাহ্যিক রূপ নিয়ে আলোচনা করে বলে একে রূপবিজ্ঞান বা অবভাস বিজ্ঞান (Phenomenology) বলে। বিভিন্ন বিজ্ঞান এই অবভাস বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।


(খ) তত্ত্ববিদ্যা (Ontology):

বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্তা সম্পর্কীয় আলোচনাকে তত্ত্ববিদ্যা বলে। 'Ontology' শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘অনটজ’ (Ontos) এবং ‘লগজ’ (Logos) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 'Ontos' শব্দটির অর্থ সত্তা এবং 'Logos' শব্দটির অর্থ বিদ্যা বা বিজ্ঞান। তাই Ontology- র অর্থ হচ্ছে সত্তাসম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান (Science of Being)।

তত্ত্ববিদ্যায় একত্ববাদ, দ্বৈতবাদ, বহুত্ববাদ, জড়বাদ, অধ্যাত্মবাদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তত্ত্ববিদ্যায় বিশ্বজগতের আদি সত্তা অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে কিনা, থাকলে তার সঙ্গে জীব ও জগতের কী সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।


(গ) মনোদর্শন (Philosophy of Mind):

মনোদর্শনে প্রধানত মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ ও মনের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি নিয়ে। আলোচনা করা হয়। মনোদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের একটি বিশেষ শাখা। হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।



জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology)

দর্শনের যে শাখা জ্ঞানের স্বরূপ, উৎপত্তি, সম্ভাবনা, সীমা ও যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করে, তাকে জ্ঞানতত্ত্ব বলে জীবন, জগৎ ও স্রষ্টার স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার আগে দার্শনিককে বিচার করে দেখতে হবে যে, যথার্থ জ্ঞান কী এবং তা লাভ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব কিনা? যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায় কী? আমরা কতটুকু জানতে পারি? আমাদের জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়? যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী? জ্ঞানের সত্যতা এবং মিথ্যাত্ব কীভাবে নিরুপণ করা যায়? জ্ঞান সম্পর্কীয় এসব জিজ্ঞাসাই জ্ঞানতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।


মূল্যবিদ্যা (Axiology)

দর্শনের যে শাখা মূল্যাবধারণ ও মূল্যবিষয়ক বচন নিয়ে আলোচনা করে তাকে মূল্যবিদ্যা বলে। মূল্যবিষয়ক রচনের স্বরূপ, সত্য-মঙ্গল-সুন্দরের স্বরূপ অবধারণ মূল্যবিদ্যার কাজ। মূল্যবিদ্যার 4 টি শাখা-

(ক) যুক্তিবিদ্যা
(খ) নন্দনতত্ত্ব
(গ) নীতিবিদ্যা
(ঘ) সমাজ দর্শন



(ক) যুক্তিবিদ্যা (Logic): 

মূল্যবিদ্যার যে শাখা সত্যের প্রকৃতি ও আকার নিয়ে। আলোচনা করে তাকে যুক্তিবিদ্যা বলে। বেঠিক যুক্তি কীভাবে সঠিক যুক্তিকে পৃথক করা যায় তার বিভিন্ন নিয়মকানুন যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত হয়।

(খ) নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics):

মূল্যবিদ্যার যে শাখা সৌন্দর্যের প্রকৃতি নির্ণয় করে তাকে নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যবিদ্যা বলে। সৌন্দর্যবিদ্যায় সৌন্দর্যের স্বরূপ, সৌন্দর্য নিরূপণের মানদণ্ড প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়।

(গ) নীতিবিদ্যা (Ethics):

মূল্যবিদ্যার যে শাখা সামাজিক ব্যক্তির কল্যাণের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে তাকে নীতিবিদ্যা বলে। নীতিবিদ্যা শুভ বা মঙ্গলের স্বরূপ, শুভের মানদণ্ড, এককথায় মানবীয় কর্মের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করে।

(ঘ) সমাজ দর্শন (Social Philosophy):

মূল্যবিদ্যার যে শাখা সমাজ কল্যাণের প্রকৃতি নির্ণয় করে তাকে সমাজ দর্শন বলে। সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির মূলে কোনো উদ্দেশ্য, আদর্শ ও মূল্য আছে কিনা- এসব বিষয় সমাজ দর্শনে আলোচিত হয়।



1.1.5. দর্শনের কাজ (Functions of Philosophy)



শিক্ষার কর্মকাণ্ড রূপায়ণে ও পরিচালনার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা তৈরির জন্য দর্শন বিভিন্ন ভাবে কাজ করে থাকে। এই ধরনের কাজগুলিকে মোটামুটিভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল- 

অনুধ্যানমূলক কাজ

অনুধ্যানমূলক কাজে শিক্ষাদর্শন সামগ্রিক পর্যবেক্ষণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে থাকে। বিজ্ঞান, ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদির সুবিন্যস্ত তথ্যসমূহ গ্রহণ করে শিক্ষাদর্শন শিখন-শিক্ষণ পরিস্থিতির একটি সামগ্রিক ধারণা গঠন করে। এই অবস্থান থেকে কাদর্শন জ্ঞানের বিভিন্ন অংশের একটা সমন্বয়সাধন করার বা একটা উপযোগী বিন্যাসে সাজানোর চেষ্টা করে।

এজন্য অবশ্য অনেকে শিক্ষাদর্শনের এই কাজকে অনুধ্যানমূলক না বলে সমন্বয়মূলক কাজ বলে আখ্যায়িত করতে চান। বলা যায় বিশ্ব পরিস্থিতি ও তাতে মানুষের স্থান সম্পর্কিত একটি মানচিত্র অঙ্কন করাই শিক্ষাদর্শনের অনুধ্যানমূলক কাজ।

অবশ্য শিক্ষাদর্শনের সংগৃহীত বিচিত্র তথ্যে সবসময় যে কেবল একটি মানচিত্র রূপলাভ করে তা নয়। বরং শিক্ষাদর্শনের সমন্বয়ের ফলাফল কখনও দু-ধারায় কখনও বহু ধারায় প্রকাশিত হয়।

এক ধারার উদাহরণ আমরা পাই ফ্যাসিবাদী শিক্ষাদর্শনে, দ্বিধারার শিক্ষাদর্শনের উদাহরণ হিসেবে সেই ভাবধর্মীয় শিক্ষাদর্শনের উল্লেখ করা যায়, আধ্যাত্মিকতা ও ইহজাগতিকতা যেখানে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত; এবং বহুধারার শিক্ষাদর্শনের উদাহরণ হল গণতান্ত্রিক শিক্ষাদর্শন যেখানে বিভিন্নমুখী ব্যক্তিত্বের ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের উন্নয়নের চর্চাকেই মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যে ধারাতেই সমন্বয় সাধিত হোক না কেন আবারও প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে যে, সে ঐক্য বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে পারছে কিনা এবং পরিবর্তনশীল চাহিদার ক্ষেত্রেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করতে পারবে কিনা। সমাজের বিভিন্ন দল-উপদলের বিভিন্নমুখী চাহিদার চাপে শিক্ষার নীতিনির্ধারণে সমন্বয়সাধনের প্রচেষ্টাও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।

এইসব পরিস্থিতিতে শিক্ষাদর্শনের কাজ হল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদানের বিশ্লেষণ করা এবং সেখানে সম্ভাব্য সাধারণ সমস্যাগুলি খুঁজে বের করে সেগুলি সমাধানের চেষ্টা করা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দিকনির্দেশনা দেওয়া। একেই বলা হয় শিক্ষাদর্শনের অনুধ্যানমূলক কাজ।



আদর্শায়নমূলক কাজ

শিখন-শিক্ষণ পরিস্থিতির উপর একটা সামগ্রিক ধারণা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদর্শন এ সংক্রান্ত ব্যাপারে লক্ষ্য, আদর্শ বা মাননির্ণয়ের কাজটিও করে থাকে। যে-কোনো বিষয়ে মূল্যাবধারণ করা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চিরাচরিত কাজ। যেহেতু শিক্ষার সঙ্গে আদর্শের একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে তাই শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে আদর্শায়ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে দর্শন তথা শিক্ষাদর্শন। 

শিক্ষাদর্শন সমন্বয়মূলক ভূমিকার ক্ষেত্রে যেমন জ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, আদর্শায়নমূলক ভূমিকার ক্ষেত্রেও তেমনি সাহিত্য, নীতিবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং অন্যান্য আচরণগত বিজ্ঞান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমাজে প্রচলিত শিক্ষাসংক্রান্ত আদর্শ বা মূল্যবোধ সম্বন্ধে অবগত হয়।

শিক্ষাদর্শন একদিকে যেমন প্রচলিত মূল্যবোধসমূহের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে বক্তব্য উপস্থাপন করে তেমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করা উচিত বা কী করলে ভালো হয় সে সম্বন্ধেও দিক নির্দেশনা দেয়। 


বিচারমূলক কাজ

এই কাজ করতে গিয়ে শিক্ষাদর্শন শিক্ষার চিন্তায় ও কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত শব্দ ও অবধারণসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষানিরীক্ষা করে। কারণ শিক্ষাদর্শন শিক্ষা কার্যক্রমের কেবল বিষয়গত যথার্থতা নয় আকারগত যথার্থতা (Validity) সম্বন্ধেও নিশ্চিত হতে চায়। এজন্য

প্রথমত, শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি যেসব অবধারণ দিয়ে তৈরি তার যথার্থতা যাচাই করে;

দ্বিতীয়ত, ব্যবহৃত ভাষাটিকে পরীক্ষা করে তার অর্থের স্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থহীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়;

তৃতীয়ত, শিক্ষাসংক্রান্ত বিবৃতিসমূহের সমর্থনের অথবা খণ্ডনের জন্য যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ গৃহীত হয় সেগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধির চেষ্টা করে।




1.2. শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ (Etymological Meaning of Education)



‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস্’ ধাতু থেকে। যার অর্থ হল শাসন করা, শৃঙ্খলিত করা, নিয়ন্ত্রিত করা, নির্দেশনা দেওয়া। শিক্ষাকে ‘বিদ্যা’ অর্থেও ব্যবহার করা হয়। এই ‘বিদ্যা’ কথাটি এসেছে ‘বিদ্’  ধাতু থেকে। যার অর্থ হল জ্ঞান। ‘শাস্’ বা ‘বিদ্যা’ উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার সঙ্গে জ্ঞানের একটা সম্পর্ক লক্ষ করা যায়।

শিক্ষা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Education’ , যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ খুঁজতে গিয়ে ভাষাবিদগণ বিভিন্ন অর্থের সন্ধান করেছেন। একটি মতবাদ অনুযায়ী ইংরেজি ‘Education’  শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ 'Educare' থেকে, যার ব্যাপক অর্থ হল পরিচর্যা করা বা শিক্ষার্থীকে জীবনোপযোগী কৌশল ও দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করা।

আবার কেউ কেউ বলেন, 'Education' শব্দটি এসেছে মূল লাতিন শব্দ 'Educere' থেকে। যার অর্থ অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার সামর্থ্য নিষ্কাশনে সহায়তা করা। অন্য একটি মতবাদ অনুযায়ী 'Education' শব্দটি এসেছে লাতিন প্রতিশব্দ ‘Educatum’ থেকে, যার মূলগত অর্থ হল শিক্ষাদানের কাজ।

প্রাচীন ভারতের দার্শনিক-ঋষিরা বলে গেছেন- পৃথিবীর মোহবন্ধন থেকে যা মুক্তি এনে দেয়, তাই শিক্ষা। উপনিষদে বলা হয়েছে- শিক্ষা মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে অর্থাৎ ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’। শংকরাচার্য -এর মতে, আত্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধিই শিক্ষা। ভারতীয় আদর্শ অনুসারে, শিক্ষার আশ্রয়েই মানুষ অন্ধকার থেকে আলোতে আসে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন- বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনকে গড়ে তোলাই শিক্ষা।

বিবেকানন্দ -এর কথায়- অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশই শিক্ষা।

গান্ধিজি -র মতে, ব্যক্তির দেহ-মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াসই শিক্ষা। শিক্ষা সংক্রান্ত এই অভিমতগুলি শিক্ষার ব্যাপকতা নির্দেশ করে। মানুষকে জীবন ও জগতের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও কর্মে উদ্বুদ্ধ হতে শেখানোই ছিল প্রাচ্য বাণী।

শিক্ষার এই বৃহত্তর অর্থই প্রাচ্য দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছিল।



পাশ্চাত্য দর্শনে শিক্ষার অর্থ (Meaning of Education According to Western Philosophy)


প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস -এর মতে- শিক্ষা হল মিথ্যার পরিহার ও সত্যের আবিষ্কার। সক্রেটিসের ভাবশিষ্য প্লেটো -র মতে, শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি, যার দ্বারা সঠিক সময়ে আনন্দ ও বেদনার অনুভূতিবোধ জন্মায়, এটি দেহের ও মনের সকল সুন্দর ও অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে তোলে। প্লেটো আরও বলেন, সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষা।

আর অ্যারিস্টট্ল -এর মতে, শিক্ষা হল আত্মার অন্তর্চক্ষুর উন্মীলন (Turning the inward eye of soul)।


আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষার অর্থ (International Education Commission and Meaning of Education)


সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন ও আধুনিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাকে অন্তরের সম্পদ (Learning: Treasure within) বলে অভিহিত করা হয়েছে। কমিশন শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনায় চারটি স্তম্ভের (Pillars) উল্লেখ করেন যা শিক্ষার বৃহত্তর অর্থের তাৎপর্য বহন করে।

স্তম্ভগুলি হল-

জানা বা জানতে শেখা (Learning to know): জানার উদ্দেশ্যে শেখা কারণ মানুষ বাঁচে তার মননের জগতে।

জানাকে কাজে লাগানো (Learning to do): কিছু করার উদ্দেশে শেখা। শুধু জানাই যথেষ্ট নয়, উৎপাদনশীল কিছু করতে শিখতে হবে। 

একত্রে বসবাসের শিক্ষা (To live together): সহাবস্থানের উদ্দেশে শেখা অর্থাৎ সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শেখা। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা।


মানুষ হয়ে উঠতে শেখা (Learning to be):

সর্বাঙ্গীণ বিকাশলাভের মধ্য দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে হবে। দেহে-মনে-বুদ্ধিতে ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ প্রকাশিত হয়ে উঠতে হবে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনের আশা, এই চারটি স্তম্ভ (Pillars of Knowledge) শিক্ষাকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবে। ব্যক্তির অন্তরের সকল ঐশ্বর্য যখন নিষ্কাশিত ও পরিমার্জিত এবং মূল্যবোধযুক্ত হয়ে উঠবে তখনই শিক্ষা বৃহত্তর অর্থ লাভ করবে।




1.2.1. শিক্ষার সংজ্ঞা (Definition of Education)






শিক্ষার অর্থ হল দেশভূমির উন্নতিকল্পে প্রশিক্ষণ ও জাতির প্রতি প্রীতি। (Education means training for the country and love for the Nation.)

-কৌটিল্য


আত্মার উপলব্ধির উপায় হল শিক্ষা। (Education is the realization of self.)

-শঙ্করাচার্য


শিক্ষা হল এমন একটি বিষয় যা মানুষকে আত্মনির্ভরশীল ও অহংমুক্ত করে তোলে। (Education is something which makes man self reliant and selfless.)

-ঋগবেদ


শিক্ষার অর্থ হল প্রকৃতি থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ। (Education means the training which one gets from Nature.)

-পাণিনি


সা বিদ্যা যা বিমুদ্ৰয়ে। (The end product of Education is to attain salvation.)

-উপনিষদ


শিক্ষা হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধন। (Education is the manifestation of perfection already in man.)

-স্বামী বিবেকানন্দ


সর্বোত্তম শিক্ষা হল সেই শিক্ষা যা আমাদেরকে কেবল তথ্যই পরিবেশন করে না। বরং বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে। (The best Education is that which does not give us information but makes our life harmonious with all existence.)

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শিক্ষা হল ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার সর্বোত্তম বিকাশসাধন। (By Education I mean allround drawing out of the best in man body, mind and spirit.)

-মহাত্মা গান্ধি


শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনো ব্যক্তির মনের সম্পূর্ণ বিকাশে সহায়ক হয়। (Education is the process of the individual mind, getting to its full possible development.)

-জাকির হোসেন
 


শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ক্রমবিকাশমান আত্মাকে নিজের মধ্যে প্রকাশ করতে সাহায্য করে থাকে। (Education means helping the growing soul to draw out that is in itself.)

-শ্রীঅরবিন্দ


শিক্ষা হল সঠিক মুহূর্তে আনন্দ ও বেদনা অনুভব করতে পারার ক্ষমতা বা শক্তি। (Education is the capacity to feel pleasure and pain in the might moment.)


-প্লেটো


সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করার নামই হল শিক্ষা। (Education is the creation of a sound mind in a sound body.)

-অ্যারিস্টট্ল


শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। (Education is childs development from within.)

-রুশো



শিক্ষা হল মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশসাধন। (Education is the development of moral characters.) 

-ফ্রেডারিক হার্বার্ট


শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহের স্বাভাবিক, সূক্ষ্ম ও প্রগতিশীল বিকাশ। (Education is natural, harmonious and progressive development of man's innate power.)

-পেস্তালাৎসি


ক্রমাগত অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনের মাধ্যমে জীবনযাপনের নামই হল শিক্ষা। (Education is the process of living through continuous recons truction of experiences.)

-জন ডিউই


জ্ঞান লাভ এবং লব্ধ জ্ঞানের ব্যবহারের মধ্যে যে কলা নৈপুণ্য নিহিত তাই হল শিক্ষা। (Education is the acquisition of the art of utilisation of knowledge.)

-হোয়াইটহেড



1.2.2. শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণা (Narrow Concept of Education)




সংকীর্ণ ধারণায় শিক্ষা বলতে বোঝানো হয় কোনো বিশেষ জ্ঞান অর্জন করা বা কোনো বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করা। যেমন- স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের ও প্রকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্ধারিত কিছু পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে পাঠ গ্রহণ করাকে শিক্ষা বলা হয়।

এই ধরনের শিক্ষা যিনি যত বেশি লাভ করেছেন তাকে তত বেশি শিক্ষিত বলা হয়। তা ছাড়া কোনো কৌশল আয়ত্ত করাকেও শিক্ষা বলা হয়। যেমন টাইপ শিক্ষা করা বা সেলাই শিক্ষা করা। তবে আধুনিক কালে বিশেষ বিশেষ শাস্ত্রের জন্য নির্ধারিত বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করার পর সনদ লাভ যিনি করেছেন তাকেই শিক্ষিত বলা হয়।

আর যাদের এ ধরনের কোনো সনদ নেই তাদেরকে অশিক্ষিত বলেই গণ্য করা হয়। শিক্ষার এই ধারণাটি বহুল প্রচলিত হলেও শিক্ষাবিজ্ঞানের বিচারে একে শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাই বলা হয়ে থাকে।


সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার Accretion ধারণার অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। এই ধারণায় বলা হয়, শিক্ষা হল শিশুর শূন্য মনে ক্রমশ জ্ঞানের সঞ্চয়। শিক্ষক বা পুস্তক হল জ্ঞানভাণ্ডার। সেই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে স্বর্ণরূপ শস্য শিশুর শূন্য মনে সঞ্চালিত হয়। একেই 'Gold Sack Theory বলে।

শিক্ষক এবং পুস্তক হল জ্ঞানের খনি। সেই খনি বা উৎস থেকে নলের মাধ্যমে জ্ঞানের স্রোতে শিশুর শূন্যপাত্র ভরে ওঠে। একে বলা হয় ‘Pipe-line Theory’।

এইভাবে শিক্ষা দ্বারা বাহ্যিক জ্ঞান শিশুর শূন্য মনে সঞ্চিত হয়। জ্ঞানসমৃদ্ধ শিক্ষক ও জ্ঞানভাণ্ডার রূপ পুস্তকের মাধ্যমে পূর্বপরিকল্পিত স্থানে (শিক্ষালয়ে) শিশুর শূন্য মনে জ্ঞান সঞ্চয় করাই হল সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার মূলকথা।



শিক্ষা জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া (Education as Acquisition of Knowledge)


শিক্ষার ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা প্রত্যয়টি ‘জ্ঞানচয়ন’ হিসেবে প্রচলিত।

এমনকি আজও ‘জ্ঞানার্জন’ শিক্ষার ধারণাটি সাধারণের কাছে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া হিসেবেই পরিগণিত। অনেকে আবার শিক্ষাকে জ্ঞানার্জনের সমার্থক মনে করেন।

প্রাচীনকালেই শুধু নয়, বর্তমান কালেও এ ধারণা সাধারণ মানুষের মনে বিদ্যমান। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বলেন- “Education is the training of the mind” অর্থাৎ শিশুকে মানসিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জ্ঞান সঞ্চয় প্রক্রিয়ায় সহায়তা করাই শিক্ষা।

  • শিক্ষা জ্ঞানার্জনের একটি প্রক্রিয়া বলতে বোঝায়, তথ্যসংগ্রহ ও মূল্যবান সংবাদ সঞ্চয়ন যা মানবজীবনের বৌদ্ধিক দিকের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। স্বভাবতই এ শিক্ষা পুথিকেন্দ্রিক। শিক্ষকের বক্তৃতা শোনা, তথ্যাদি মুখস্থ করা এবং পুনরাবৃত্তি বা অনুশীলন জ্ঞান আহরণের অপরিহার্য উপায়। কিন্তু এই ধারণা শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে স্থির বস্তুতে পরিণত করেছে- Reduces education to a totally static affair.
  • শিক্ষা জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া শিক্ষার এই সংজ্ঞাটি মনোবিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তা ছাড়া শিক্ষার এই সংজ্ঞা মানবমনের সক্রিয় ভূমিকা বা সৃজনক্ষমতাকে বিবেচনার মধ্যে আনে না।



অতএব শিক্ষা জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া- এই ধারণাটি শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত।

এ ধারণা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হয়ে পড়ে অপরিবর্তনীয় যেখানে পাঠক্রম সীমিত ও শিক্ষা পদ্ধতি যান্ত্রিক অনুশীলনের নামান্তর। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক মানবতাবর্জিত। বর্তমান কালে শিক্ষার এই ধারণা গ্রহণীয় নয়। শিক্ষাকে এখন ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়।


শিক্ষার শক্তিবাদ (Faculty Theory of Education)

শিক্ষার অপর একটি প্রাচীন তত্ত্ব ‘শক্তিবাদ’ কে শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। শিক্ষার ‘মানসিক শক্তিবাদ’ মনস্তত্ত্বের ‘শক্তিবাদ’ (Faculty Theory) থেকেই উদ্ভূত। এখানে বলা হয়েছে, ‘মন’ হল কতকগুলি সহজাত এবং পরস্পর পৃথক শক্তির সমন্বয়; যেমন- মনোযোগ, পর্যবেক্ষণ, স্মৃতি, কারণ নির্ণয়, কল্পনা ইত্যাদি।

কোনো একটি বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে যে- কোনো একটি শক্তির যদি চর্চা হয় তাহলে সর্বক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে। যেমন- গণিতের চর্চা যদি ‘কারণ- নির্ণয়’ শক্তির উন্নতি ঘটায় তার প্রভাব অন্য বিষয়েও প্রতিফলিত হবে যদি বিষয়টি শিখনের জন্য কারণ-নির্ণয় ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।

এই মতবাদের সমর্থকগণ মনে করেন, সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ বৈশিষ্ট্যের দরুন কোনো কোনো বিষয় শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই বিষয়গুলি হল লাতিন, গণিত এবং ব্যাকরণ। শিক্ষা হল এইসব বিষয়গুলির শিখন এবং শিক্ষণ।

শিক্ষার এই ধারণাটি শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যা বর্তমানে পরিত্যক্ত।


সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার অনেক ত্রুটি লক্ষ করা যায়-

প্রথমত, শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থে জ্ঞানের ধারণা সীমাবদ্ধ। ‘জ্ঞান’ -কে এখানে কেবলমাত্র স্মৃতিগ্রাহ্য তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক ধ্যানধারণাকেই এখানে জ্ঞান বলে মনে করা হয়েছে- যা অনেক সময়েই শিশুর অভিজ্ঞতা এবং ক্ষমতার বাইরে।

এখানে শিক্ষাকে পরিমাণগতভাবে বিবেচনা করা হয়, গুণগতভাবে নয়।

দ্বিতীয়ত, মনস্তত্ত্বের দিক থেকেও শিক্ষার এই সংজ্ঞা সমর্থনযোগ্য নয়। শিশু অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে এখানে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হয়েছে। তার দেহ-মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, সহজাত গুণাবলি, প্রবণতা, ক্ষমতা এবং আগ্রহকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

ব্যক্তিগত পার্থক্যকে বিবেচনা করা হয়নি, সকলকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একই পরিমাণে পুথিগত বিদ্যা দিয়ে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বাচনিক জ্ঞাননির্ভর। শিশুর শারীরিক বিকাশের কথা উল্লেখ এখানে করা হয়নি।

উল্লেখ করা হয়নি তার দেহ ও মনের বিকাশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। শিক্ষার এই ধারণায় শিশুর আবেগবিকাশ একেবারেই অনুল্লিখিত থেকে গেছে।

তৃতীয়ত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেও সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার অনেক ত্রুটি দেখা যায়। পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করে অর্থপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি বিবেচনার বাইরে থেকে গেছে। অতীত, প্রথাগত এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সমাজের বর্তমান সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ প্রগতির কথা এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। মনে করা হয়েছে, সমাজ সম্পর্কিত পুথিগত জ্ঞান শিশুকে সামাজিকীকরণের পক্ষে যথেষ্ট। সামাজিক মানুষে পরিণত হতে হলে যে সামাজিক অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সামাজিক জীবনযাপনের কৌশল আয়ত্ত করা প্রয়োজন সে কথা চিন্তা করা হয়নি।

শিক্ষার সঙ্গে জীবনের, বিদ্যালয়ের সঙ্গে সমাজের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

চতুর্থত, দার্শনিক দিক থেকেও শিক্ষার এই ব্যাখ্যাটিকে সমর্থন করা যায় না। জন ডিউই র মতে, শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাটি জ্ঞান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। পুস্তক বা বক্তব্যের মধ্য থেকে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা ব্যক্তি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে পরীক্ষা করে, প্রয়োজন মতো পুনর্গঠন করে, যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গ্রহণ করলে তা বাস্তব হয়। অন্যথায় এটা কেবলমাত্র তথ্যসংগ্রহ, বক্তব্যপ্রধান এবং প্রথাগত চরিত্রের হয়।

প্রকৃত জ্ঞান বাইরে থেকে শিশুর মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় না। বাস্তবের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়। এইভাবে বলা যায় দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং শক্তিবদ্ধ কোনো দৃষ্টিভঙ্গিই শিক্ষার সংকীর্ণ অর্থ সমর্থন করে না।


1.2.3. শিক্ষার ব্যাপক ধারণা (Broader Concept of Education)



ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হচ্ছে জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। এই অর্থে অভিজ্ঞতা অর্জনই শিক্ষা। সুতরাং কোনো মানুষই অশিক্ষিত নন কারণ কোনো মানুষই অভিজ্ঞতাবিহীন নন। যিনি জ্যোতির্বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনিও যেমন শিক্ষিত তেমনি যিনি আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে বৃষ্টি হওয়ার কতখানি সম্ভাবনা আছে সে কথা বলতে পারেন তিনিও শিক্ষিত। 

এই অর্থে শিক্ষা শুধু পুথিগত বিদ্যার মাধ্যমেই সীমিত নয়। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখে অন্যকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারার যোগ্যতা অর্জন করাও শিক্ষা। সুতরাং শিক্ষাবি মতে, চলমান জীবনের পথে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যে-কোনোভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের অবিরাম প্রক্রিয়ার নাম শিক্ষা। 

জন্মমুহূর্ত থেকে এই প্রক্রিয়ার শুরু এবং চলতে থাকে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে জীবনের সঙ্গে সমব্যাপী। শিক্ষার ব্যাপক অর্থ হল নিষ্কাশন করা বা নির্দেশনার মাধ্যমে এগিয়ে চলা। শিক্ষার এই অর্থ মনোবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তি মাত্রই অনন্ত শক্তির আধার।

শিক্ষার কাজ হল ব্যক্তির শক্তি ও সম্ভাবনার পূর্ণ প্রকাশসাধন এবং ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণসাধন। শিক্ষা দার্শনিক অ্যাডামস্, নান, জন ডিউই প্রমুখ অনেকেই শিক্ষা বলতে ব্যক্তিত্বের পূর্ণ প্রকাশকেই বুঝিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি, শ্রীঅরবিন্দ শিক্ষা বলতে মানুষের অনন্ত শক্তি ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ ও সার্থক বিকাশের কথাই বুঝিয়েছেন। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে শিক্ষার একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যেমন-


শিক্ষা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া:

শিক্ষা ব্যক্তির সমগ্র জীবনব্যাপী এক প্রক্রিয়া। ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়া অব্যাহত। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি ব্যক্তিকেই পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করে চলতে হয়। এই অভিযোজনের ফলে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে শিক্ষা লাভ করে। Moore তাই বলেন, “যতদিন আমরা বাঁচি ততদিন শিখি (Education is a life-long process)। বস্তুত, শিক্ষা আর জীবন সমার্থক।


শিক্ষা হল বৃদ্ধি ও বিকাশ:

মানবজীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল বৃদ্ধি বা Growth; শিক্ষা আর বৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা হল বৃদ্ধি ও বিকাশের সামগ্রিক এক প্রক্রিয়া। জীবন অভিজ্ঞতা থেকেই বিদ্যার্থী তা আহরণ করে। শিশু জন্মসূত্রে যে সম্ভাবনা নিয়ে আসে, শিক্ষার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। ডিউই-র মতে –শিক্ষা হল শিশুর বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলির পূর্ণ বিকাশ।

পেস্তালাৎসি বলেন- মানুষের সহজাত শক্তিগুলির ধারাবাহিক, সুসংহত বিকাশই হল শিক্ষা।


মানব ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ হল শিক্ষা: শিক্ষা হল মানবসত্তার দৈহিক, নৌদ্ধিক, নৈতিক, নান্দনিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তির সমন্বিত বিকাশ বা Harmo nious development. মানব ব্যক্তিত্বের পূর্ণ প্রকাশই শিক্ষার মর্মকথা। The complete development of individuality is the essence of education.


শিক্ষা সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তাই সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিশু সামাজিক প্রকৃতি লাভ করে। শিশুর অনন্ত গুণ, অনন্ত শক্তি, অনন্ত সম্ভাবনাময় প্রকৃতি সামাজিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বহুবিধ অভিজ্ঞতার সাহায্যে শিশুর অন্তরস্থ মানব প্রকৃতি বিকশিত হয়ে ওঠে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বে।

একেই সামাজিকীকরণ বা Socialization বলে অভিহিত করা হয়। ডুর্কহেইম -এর মতে- শিক্ষা প্রক্রিয়াটি বস্তুত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, “শিক্ষা প্রক্রিয়া শিশুকে সার্বিকভাবে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলে।”


শিক্ষা সংগতিবিধানের প্রক্রিয়া:

শিক্ষাই জীবন। আর জীবন হল পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির নিরবচ্ছিন্ন অভিযোজন। শিক্ষার কাজ হল ব্যক্তিকে সামাজিক, প্রাকৃতিক, প্রাক্ষোভিক ও নৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজনে সক্ষম করে তোলা।


শিক্ষা অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন:

শিক্ষা হল অভিযোজন, নিরন্তর অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়। প্রসঙ্গত ডিউই বলেন- “ব্যক্তি চলার পথে তার শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ক্ষমতা আগ্রহ এবং প্রবণতা অনুযায়ী অভিজ্ঞতাগুলি পুনর্গঠিত করে।” এইভাবে বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসৃজন।


শিক্ষা জীবনমুখী ও বহুমুখী প্রক্রিয়া:

ব্যাপক অর্থে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পাঠক্রম, সমাজের প্রত্যাশা, স্বশিখন প্রভৃতির গুরুত্ব বর্তমানে স্বীকৃত।

 প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বিধিমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, দূর শিক্ষা, মুক্ত শিক্ষা প্রভৃতি নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে বহুমুখী। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা জীবনমুখীও বটে। ‘আত্মদীপা ভবঃ’ মন্ত্রটি জীবনমুখী শিক্ষার আলোকবর্তিকা।


শিক্ষা পরিবর্তনশীল:

জীবজগতে স্থির কোনো বস্তু নেই, নেই কোনো অক্ষয় সত্য। যা অস্তিত্বশীল তাই পরিবর্তনশীল। সমগ্র জগতে পরিবর্তনের ধারা সর্বক্ষণ চলমান। তাই শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি সতত পরিবর্তনশীল। ডিউই -র মতে- মানবমন একটি স্থির বস্তু নয়। তাঁর ধারণায়, মন একটি বৃদ্ধি প্রক্রিয়া (A process of growth), যা সদা পরিবর্তনশীল ও চির বিকাশমান। শিক্ষা ধারায় একটি ঐক্য বিদ্যমান। আর এটিই ব্যাপক অর্থে শিক্ষা।



1.2.4. শিক্ষার সংকীর্ণ এবং ব্যাপক ধারণার মধ্যে পার্থক্য (Difference between Narrow and Broader Concept of Education)


সংকীর্ণ অর্থ ও ব্যাপক অর্থ

অর্থ

(সংকীর্ণ অর্থ)- জ্ঞান ও দক্ষতা হস্তান্তর। শিক্ষক বা পুস্তক মারফত এই জ্ঞান ও দক্ষতা হস্তান্তর হয়।

(ব্যাপক অর্থ)- শিক্ষা হল বিকাশ, সমাজিকীকরণের প্রক্রিয়া, সংগতিবিধানের প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন, বহুমুখী প্রক্রিয়া ইত্যাদি।


লক্ষ

(সংকীর্ণ অর্থ)- (ক) ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি।
(খ) 3’R সম্পর্কে জ্ঞন
(গ) মানসিক শক্তির উন্নতি।

(ব্যাপক অর্থ)- (ক) ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি এবং বর্তমান জীবন উপভোগ করা।
(খ) 7’R সম্পর্কে জ্ঞান। Reading, Writing, Arithmatic, Recreation, Rights and Responsibility, Relationship, Citizenship Training.


সংস্থা

(সংকীর্ণ অর্থ)-  বিদ্যালয়, পরিবার এবং চার্চ।

(ব্যাপক অর্থ)- বিদ্যালয়, পরিবার, রেডিয়ো, সিনেমা, প্রেস ইত্যাদি।


বিদ্যালয়ের আবহাওয়া

(সংকীর্ণ অর্থ)- (ক) একঘেয়ে, শিক্ষার্থী নিষ্ক্রিয় থাকে।
(খ) সামাজিকীকরণ নয়।
(গ) জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন।

(ব্যাপক অর্থ)- (ক) উৎফুল্ল, শিক্ষার্থীর সক্রিয় সহযোগিতার মনোভাব।
(খ) সামাজিকীকরণ উৎসাহিত হয়।
(গ) জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।



বিষয়বস্তু

(সংকীর্ণ অর্থ)- বিভিন্ন বিষয়ের উপর গুরুত্ব। বহুমুখী পাঠক্রম নয়।

(ব্যাপক অর্থ)- বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন কার্যাবলি, বহুমুখী পাঠক্রম।


শিক্ষার্থীর অবস্থান

(সংকীর্ণ অর্থ)- (ক) নিষ্ক্রিয় শ্রোতা।
(খ) নির্দিষ্ট মানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(ব্যাপক অর্থ)- (ক) শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা।
(খ) 4A-র উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়- Age, Aptitude, Ability, Aim.


শিক্ষণপদ্ধতি

(সংকীর্ণ অর্থ)- (ক) দলগত পদ্ধতি।
(খ) স্মৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
(গ) মৌখিক নির্দেশনা এবং আবৃত্তি।
(ঘ) কেবলমাত্র শ্রেণিকক্ষের কাজ।

(ব্যাপক অর্থ)- (ক) ব্যক্তিগত ও দলগত উভয় পদ্ধতি।
(খ) চিত্ত, কারণ নির্ণয়, আবিষ্কার, বিচারকরণ এবং প্রকাশকরণ ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(গ) প্রশ্ন, আলোচনা, বিতর্ক, কাজের মাধ্যমে শিক্ষা।
(ঘ) ভ্রমণ, লাইব্রেরির কাজ ইত্যাদি।



শিক্ষকের অবস্থান

(সংকীর্ণ অর্থ)- (ক) নিয়মকানুন রক্ষাকারী আমলাতন্ত্রের মতো
(খ) মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ খুব কম।
(গ) শিক্ষককে ভয় করে।
(ঘ) বাহ্যিক শৃঙ্খলা। পুরস্কার এবং তিরস্কারের সাহায্যে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(ব্যাপক অর্থ)- (ক) বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক।
(খ) মনোবিজ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(গ) বিষয় ও শিক্ষার্থীকে জানা।
(ঘ) শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে।
(ঙ) অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ভালোবাসা ও সহানুভূতি হল শৃঙ্খলার উৎস।


1.2.5. শিক্ষার বৈশিষ্ট্য (Features of Education)




এইসব দার্শনিকের অভিমতগুলি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ বিচারবিবেচনা করলে শিক্ষার বৃহত্তর অর্থটি পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষাকে গ্রহণ করলে তার মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় সেগুলি হলো-

1. শিক্ষা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া (Education is a life-long process): বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা কোনো স্থির প্রক্রিয়া নয়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ এক অবিরাম প্রক্রিয়া- ক্রমবিকাশমান গতিশীল জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া হল শিক্ষা। জীবন বিকাশের এমন কোনো স্তর নেই যখন শিক্ষা নিষ্প্রয়োজন। এটি কেবল প্রস্তুতি পর্ব মাত্র নয়, বরং জীবনই শিক্ষা। শিক্ষাই জীবন (Education is life itself)। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুসারে শিক্ষা মানবজীবনের সঙ্গে সমব্যাপক। 

2. শিক্ষা বৃদ্ধি ও বিকাশ (Education is growth and development): মানবজীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল বৃদ্ধি বা Growth । শিক্ষা আর বৃদ্ধি সমার্থক। শিক্ষা হল বৃদ্ধি ও বিকাশের সামগ্রিক এক প্রক্রিয়া। মানবশিশুর অন্তর্নিহিত অনন্ত শক্তি, অনন্ত গুণ এবং অনন্ত সম্ভাবনার বিকাশই হল শিক্ষা।

বৃদ্ধির অর্থ হল পরিণমনের দিক থেকে গড়ে ওঠা। যথা- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের (হাত, পা, মস্তিষ্ক ইত্যাদি) বেড়ে ওঠা। আর বিকাশ হল শিশুর গুণগত পরিবর্তন- শিক্ষার মাধ্যমে সুপ্ত সম্ভাবনাগুলির প্রকাশ।

উপযুক্ত পরিচালনা ও নির্দেশনার মধ্য দিয়ে নিষ্কাশিত গুণগুলির বিকাশ ও বৃদ্ধি হয়। এই প্রসঙ্গে রুশো -র কথা প্রণিধানযোগ্য।

রুশো বলেন- “চারাগাছগুলি ঠিকমতো গড়ে তুলতে গেলে চাই কর্ষণ, মানুষের জন্য চাই শিক্ষা।”

ফ্রয়েবেল -এর বিদ্যালয় হল ‘শিশু উদ্যান’।

বাগানের উন্মুক্ত পরিবেশে চারাগাছ যেমন পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে, শিশুও তেমনি পরিবেশের স্বাধীনতায়, সক্রিয়তায়, স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত হয়ে উঠবে।

রুশো -র কথায়- “আত্মবিকাশই শিক্ষা।” আর এই বিকাশ হল ছেদহীন, নিরবচ্ছিন্ন এক প্রক্রিয়া।



3. শিক্ষা সমন্বিত পূর্ণ প্রকাশ (Education is harmonious development):

বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা মানবসত্তার দৈহিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক, নান্দনিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তির সমন্বিত পূর্ণ প্রকাশ। মানব ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশই শিক্ষার মর্মকথা বা Essence। সুপ্ত শক্তির নিয়ন্ত্রিত বিকাশই শিক্ষা- সক্রেটিস ও প্লেটো এই মতের প্রবক্তা।

রেমন্ট, ডিউই প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ শিক্ষাকে শিশুর অন্তর্নিহিত শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ বলে অভিহিত করেন। তাঁরা শিক্ষাকে শিশুর অনন্ত শক্তির বিকাশের সমার্থক বললেও এই বিকাশে পারিবেশিক প্রভাবের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।


4. বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষায় বিকাশের অর্থ (Scientific view of the meaning of development):

জীববিজ্ঞানের দিক থেকে পরিণমন প্রক্রিয়াকেই বিকাশ বলে অভিহিত করা হয়। অপরিণত শিশু অনও সম্ভাবনা-সামর্থ্যের আধার। এ শক্তি- সম্ভাবনা প্রাথমিকভাবে নমনীয় ও অকার্যকরী অবস্থায় থাকে। এই শক্তির ক্রম পরিস্ফুটন ও পূর্ণতালাভ বিকাশের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে বিকাশের এ ধারণা অনেকটা নেতিবাচক।
বিকাশকে এভাবে দেখলে শিক্ষা হবে অপরিণত থেকে পরিণতির দিকে যাওয়া, শূন্য থেকে পূর্ণে যাওয়া। কিন্তু পূর্ণ থেকে পূর্ণ হয়, শূন্য থেকে শূন্য হয়। অপরপক্ষে সদর্থক দিক থেকে বিকাশ হল এমন একটি শক্তি যা ক্রমবর্ধমানকে সর্বাঙ্গীণ প্রকাশে সহায়তা করে।

যেখানে জীবন, সেখানেই বৃদ্ধি ও বিকাশ। বিকাশ হল নিয়ত গতি–বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে।

কান্ট বলেন- “Education is the development in the individual by all the perfection by which he is capable”। 

অনুরূপভাবে বিবেকানন্দ বলেন, “অন্তঃস্থিত মহত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশই শিক্ষা।”


5. শিক্ষা অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসৃজন (Reorganization and regeneration of experience is Education):

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছে। পূর্বমুহূর্তে যে অভিজ্ঞতা সত্য ছিল পরমুহূর্তে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার স্থান নেয় আর এক নতুন অভিজ্ঞতা।

মানবজীবনের এই অভিজ্ঞতার বিরামহীন সৃষ্টি, পরিবর্তন ও পুনর্গঠনকেই ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলা যায়। বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা বলতে কেবল স্কুল-কলেজে প্রাপ্ত বিদ্যা বা বিশেষ শিল্পে অর্জিত পারদর্শিতাকেই বোঝায় না। বরং পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় পরিবেশ থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ নব নব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চলেছে।

তাই বর্ণমালার জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তিকেও শিক্ষিত বলা যেতে পারে। শিক্ষা সতত পরিবর্তনশীল (Education is dynamic)। বৃহত্তর অর্থে, শিক্ষা কোনো স্থির পদার্থ নয়। নয় কোনো অক্ষয় সত্য। কারণ যা অস্তিত্বশীল তাই পরিবর্তনশীল।

সমগ্র জগতে পরিবর্তনের ধারা সর্বক্ষণ চলমান। নদীর স্রোতের ন্যায়, প্রদীপের শিখার ন্যায় সদা চঞ্চল ও সদা গতিশীল। ডিউই -র মতে, মানবমন একটি স্থির বস্তু নয়, মন একটি বৃদ্ধি প্রক্রিয়া- A process of growth।

সতত পরিবর্তনশীল ও চিরবিকাশমান। তবে এই বিকাশের ধারায় আদ্যন্ত একটি ঐক্য বিদ্যমান।


6. মানব আচরণের অভিযোজন হল শিক্ষা (Education is human behaviour adjustment):

ব্যাপক অর্থে মানব আচরণের স্থায়ী পরিবর্তনের এক বিরামহীন প্রক্রিয়া হল শিক্ষা। এ প্রক্রিয়া জীবন জুড়ে অব্যাহত। নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের ধারাবাহিক অভিযোজনকে শিক্ষা নামে অভিহিত করা হয়। শিক্ষা শুধুমাত্র জৈবিক প্রয়োজনই নয়, এর সামাজিক প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম। শিক্ষা ব্যক্তিকে অভিযোজনে বা যে -কোনো উদ্দেশ্য সফল করার কাজে সক্ষম করে তোলে।

Ross বলেন- “যে সামাজিক পরিবেশে ব্যক্তি বিকশিত ও প্রকাশিত হয়েছে, সে সামাজিক পরিবেশ ছাড়া ব্যক্তিসত্তা মূল্যহীন এবং ব্যক্তিত্ব অর্থহীন।” মানুষ সামাজিক জীব- অ্যারিস্টট্ল -এর একথা সর্বজনবিদিত। তাই সমাজকে বাদ দিয়ে শিক্ষার কথা ভাবাই যায় না। ম্যাকেঞ্জি -র মতে- মানব ব্যক্তিত্বের বিকাশ বা আত্মোপলব্ধি হল শিক্ষা।

হোয়াইটহেড বলেন, “There is only one subject-matter of education and that is life in all its manifestations.” ব্যক্তিকল্যাণের মতো সমাজকল্যাণও শিক্ষার লক্ষ্য। তাই শিক্ষা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া- সহযোগিতা, সামাজিকীকরণ, সাংস্কৃত্যায়ন, সামাজিক সংহতি রক্ষায় শিক্ষা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিজীবন, জাতীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়ন করে শিক্ষা।

এই সকল পরিবর্তনই শিক্ষার ফসলও বটে। তাই শিক্ষা একাধারে অভিযোজন প্রক্রিয়া (Process) ও ওই প্রক্রিয়ারই ফসল (Product)।



7. মানুষ নিজেই তার আদর্শ বহন করে (Man bears with him his own ideal):

এই কথার অর্থ মানুষের বিকাশের আদর্শ মান তার নিজের মধ্যেই নিহিত আছে। জিন বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথাটি সত্য প্রমাণিত। বিস্তৃত অর্থে মানবসত্তার সমন্বিত বিকাশই হল শিক্ষা। দৈহিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, নান্দনিক ইত্যাদির সমন্বিত পূর্ণ প্রকাশই হল শিক্ষা-লুনাচারস্কি এই ধারণা পোষণ করেন।


1.2.6. শিক্ষার কাজ (Functions of Education)


মানবজীবনে শিক্ষার গুরুত্ব তথা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিক্ষার দ্বারা মানুষের জীবনের পরিবর্তন ঘটে। শিক্ষার সাহায্যে ব্যক্তি তার সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবকে অনুকূল করে। বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার কার্যাবলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

1. মুখ্য কাজ (Primary Functions)

2. গৌণ কাজ (Secondary Functions)


1. মুখ্য কাজ (Primary Functions)

 শিক্ষার বিভিন্ন কাজের মধ্যে যেসব কার্যাবলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেইগুলি হল-

ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ: শিক্ষা বিভিন্ন প্রকার বিকাশ যেমন– শারীরিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি সংগঠিত করে ব্যক্তির সুষম বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।

জীবনের অভিমুখ নির্দেশ: জীবনের অভিমুখ নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি জীবনের বিকাশ ঘটায় শিক্ষা। এজন্য প্রাচীন ভারতে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, অসত্য থেকে সত্যের পথে, অন্ধকার থেকে জ্যোতির দিকে এবং জড়জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত করে অমৃতলোকের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হল শিক্ষার কাজ।

সমাজকল্যাণ: শিক্ষা ব্যক্তিকে একজন সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। কারণ, শিক্ষার চারটি উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য হল- Learning to be যা প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে, শিক্ষার কাজ হল ব্যক্তিকে সমাজের মধ্যে সংগতিবিধানে সাহায্য করা।


2. গৌণ কাজ (Secondary Functions)

শিক্ষা ব্যক্তিকে সৎ চরিত্রের অধিকারী হতে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ শিক্ষাক্ষেত্রে 'Character building' -এর উপর জোর দিয়েছেন। মুদালিয়ার কমিশনের মতে, Education process should be the training of character and personality of a student। সদা পরিবর্তনশীল ও দ্রুত উন্নয়নশীল সমাজের সঙ্গে যথার্থ অভিযোজন করতে হলে শিক্ষার্থীকে অত্যাধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে হবে এবং এই কাজ করতে শিক্ষা আমাদের সাহায্য করে থাকে।
 

মানবসম্পদ উন্নয়ন: যে- কোনো সামাজিক বা প্রাকৃতিক সম্পদ স্বাভাবিক নিয়মে লাভ করলেও মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হয়। আর এই মানবসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষা যথার্থভাবে সাহায্য করে থাকে। 

জাতীয় সংহতি: শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে সংহতিবোধের উন্মেষ ঘটায়। সঠিকভাবে শিক্ষালাভের মাধ্যমেই শিক্ষার্থী জাতীয় সংহতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে থাকে।

সামাজিকীকরণ: সমাজের একজন সদস্য হিসেবে সমাজের নিয়মকানুন, আচার-আচরণ, আদবকায়দার সঙ্গে পরিচিত হওয়া, নিজের মর্যাদা রক্ষার সাহায্য করে শিক্ষা। তাই বলা হয়, ব্যক্তির সামাজিকীকরণ একমাত্র শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব।

সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন: সমাজজীবনে শৃঙ্খলা স্থাপনে শিক্ষার গুরুত্ব প্রশংসনীয়।

ব্যক্তিগত দক্ষতার বৃদ্ধি: আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল কর্মভিত্তিক পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বৃত্তিমূলক দক্ষতার বৃদ্ধি ও বিকাশসাধন করা।

নৈতিক বিকাশ: ব্যক্তির মধ্যে নীতিগত বিকাশের ক্ষেত্রেও শিক্ষা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

প্রাক্ষোভিক বিকাশ: বাল্যকালে শিশুর মধ্যে যেসব প্রক্ষোভ লক্ষ করা যায় যৌবনকালে সেইসব প্রক্ষোভগুলি পরিশীলিত হয় শিক্ষা গ্রহণের ফলে।

সৃজনশীলতার বিকাশ: আধুনিক শিক্ষার অন্যতম কাজ হল শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো।

মূল্যবোধের বিকাশ: আধুনিক শিক্ষা ব্যক্তিগত নৈতিক বিকাশের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবাধিকার সম্পর্কিত মূল্যবোধ বিকাশের হাতিয়ার।



1.2.7. শিক্ষার প্রকৃতি (Nature of Education)


শিক্ষার ব্যাপকতর ধারণা, বিবিধ সংজ্ঞা, এবং দর্শনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে শিক্ষার প্রকৃতি সম্বন্ধে যে চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে তার সারসংক্ষেপ পাঠ করলে দেখা যায় শিক্ষার প্রকৃতিও কিছুটা জটিল। শিক্ষা প্রায়শ দুটি বিপরীতমুখী প্রক্রিয়ার সমন্বয়।

1. শিক্ষা প্রক্রিয়া ও প্রান্তিক ফল (Education is process as well as product): শিক্ষা জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হিসেবে যেমন সক্রিয় তেমনি জীবনের বিশেষ এক একটি মুহূর্তে ব্যক্তির অর্জিত অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে শিক্ষার অন্তিম ফল হিসেবেও দেখা হয়। সমষ্টিতে শিক্ষার অন্তিম ফল হিসেবেও দেখা হয়। প্রান্তিক ফলের বিচারে শিক্ষা ব্যক্তিগত বৈষম্যেরও কারণ।

2. শিক্ষা একমুখী ও ত্রিকোটিক (Education is unilateral as well as tripolar): শিক্ষা একমুখী কারণ শিক্ষার প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে ক্রমাগত উন্নততর আচরণ অভিমুখে পরিচালিত করে। শিক্ষা কখনও ব্যক্তি বা সমাজকে পশ্চাৎমুখী করে না। Adamas বলেছিলেন শিক্ষা দ্বিকোটিক (Bipolar) প্রক্রিয়া কারণ এর এক দিকে আছে শিক্ষার্থী, অপরদিকে শিক্ষক। আধুনিক শিক্ষা চিন্তায় সমাজকে

শিক্ষার তৃতীয় মেরু হিসেবে দেখা হয় কারণ শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক কোনোটিই সমান নিরপেক্ষ নয়।

3. শিক্ষা রক্ষণশীল ও সংস্কারমুখী (Education is conservative as well as reformative):

শিক্ষা কোনো জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিশীলিত রূপটিকে সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করে এবং পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত করতে চায়। সেই কারণে শিক্ষা রক্ষণশীল। কিন্তু সেই সঙ্গে জ্ঞান ও দক্ষতার অগ্রগতি, সমাজের বর্জনীয় রীতিনীতির সংস্কারসাধন, সৃজনশীলতার চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা এক সংস্কারমুখী ভূমিকা পালন করে। এই জন্য শিক্ষা রক্ষণশীল ও সংস্কারমুখী দুইই।

4. শিক্ষা সমাজমুখী ও ব্যক্তিমুখী (Education is socially as well as individually oriented):

শিক্ষা একদিকে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ প্রক্রিয়া অন্যদিকে সামাজিক চাহিদা ও পরিবেশেরও পরিপোষক। আপাতদৃষ্টিতে দুই বিপরীতমুখী গতি মনে হলেও শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া হিসেবেও বিবেচিত।

5. শিক্ষা জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার সেতু (Education is the bridge between nationalism and internationalism):

শিক্ষার বিষয়বস্তু, পদ্ধতি, মান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সংযোগ আজ এক অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান। জাতীয়তাবোধের বিকাশ শিক্ষার মাধ্যমে যতটা প্রয়োজনীয় ততটাই প্রয়োজনীয় বিশ্বমানবিকতার বিকাশ।

6. শিক্ষা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমুখী প্রক্রিয়া (Education is planned and purposive process):

শুধুমাত্র প্রথাগত শিক্ষা নয় অপ্রথাগত শিক্ষার পিছনেও থাকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য। প্রাচীনকালের একক গুরুগৃহে যে শিক্ষালাভ হত সেখান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষাই উদ্দেশ্যবিহীন ও যথেচ্ছভাবে হয়নি।

7. শিক্ষা একাধারে একটি বিদ্যা এবং বৃত্তিমূলক (Education is a discipline as well as vocational):

শিক্ষা একটি বিদ্যা কারণ তার নিজস্ব দর্শন, সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য ও ভাষা আছে। পদ্ধতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শিক্ষাবিষয়ক যে চর্চা নিরন্তর হয়ে চলেছে তা ক্রমাগত এই বিদ্যাকে পরিপুষ্ট করে। অন্যদিকে শিক্ষা নিজেই একটি বৃত্তি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আছে বৃত্তিমুখী উদ্দেশ্য।

৪. শিক্ষা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় (Education is integration of knowledge and experience):

বিদ্যা হিসেবে শিক্ষা যেমন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির এক শক্তিশালী হাতিয়ার তেমনি পাঠক্রম ও তার কার্যকারিতা প্রধানত ব্যক্তির অভিজ্ঞতার বুনিয়াদ দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত।

9. শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া (Education is a life-long process):

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিক্ষাই জীবন ও জীবনই শিক্ষা।


অর্থাৎ এই শিক্ষার প্রসার আজীবন। Lodge- এর মতে, “Life is Education and Education is life”। আবার এই প্রসঙ্গে Moure বলেছেন, “আমরা যতদিন বাঁচি ততদিনই আমরা শিখি।”

10. শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন (Education is reorganization of experience):

ব্যক্তি শিক্ষার সাহায্যে তার চলার পথের পাথেয় শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ক্ষমতা ও আগ্রহ প্রবণতা অনুযায়ী অভিজ্ঞতাগুলি পুনর্গঠিত করে থাকে।

11. শিক্ষা হল একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া (Education is an automatic process):

আধুনিক কালে, শিক্ষাকে একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেগুলি হল- অভিজ্ঞতার নিরবচ্ছিন্ন পুনর্গঠন, বিকাশমুখিতা ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

12. শিক্ষা হল ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (Education is a continuous process):

কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাকে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেগুলি হল- অভিজ্ঞতার নিরবচ্ছিন্ন পুনর্গঠন, বিকাশমুখিতা ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

13. শিক্ষা হল অভিযোজনমূলক প্রক্রিয়া (Education is an adjustable process):

শিক্ষা শিক্ষার্থীকে তার বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে সংগতিবিধানে সাহায্য করে থাকে। তিন ধরনের পরিবেশের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়ে থাকে। সেগুলি হল- প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ ও প্রাক্ষোভিক পরিবেশ।


1.2.8. শিক্ষার পরিধি (Scope of Education)


শিক্ষা হল একটি 'Applied Social Science' (প্রয়োগমূলক সমাজবিজ্ঞান)। তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনার পাশাপাশি শিক্ষার একটা প্রয়োগমূলক (Practical) দিকও আছে। সমাজ ও ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য শিক্ষাবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ হল ব্যক্তির আচরণকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা। এই কাজে শিক্ষাবিজ্ঞান সাহায্য নিয়েছে মনোবিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, মানসিক স্বাস্থ্যতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, শিক্ষা প্রযুক্তি, পরিসংখ্যান ইত্যাদির।

শিক্ষাবিজ্ঞান এইসব বিষয় থেকে তথ্যাবলি সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে তার কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় এর পরিধি হয়েছে যথেষ্ট সুবিস্তৃত। তাই শিক্ষার পরিধি নির্ণয় করা অত্যন্ত শক্ত কাজ।

1. দর্শনশাস্ত্র- দর্শনের ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ, প্রয়োগবাদ, সমাজবাদ ইত্যাদি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

2. মনোবিজ্ঞন- মনোবিজ্ঞানের গবেষণার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। মানুষের নানাবিধ আচরণের উপর গবেষণা করে মনোবিদ্যা যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীর মনোযোগ, ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত বৈষম্য, বুদ্ধি, স্মৃতি, শিক্ষণ-শিখন প্ৰক্ৰিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলির একেবারে আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

3. রাশিবিজ্ঞন- রাশিবিজ্ঞান ছাড়া তো শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অগ্রগতির মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার একটি আবশ্যকীয় কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীর অগ্রগতির পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা। তাই রাশিবিজ্ঞানের জ্ঞানার্জনের জন্য তার চর্চা করা শিক্ষাবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

4. মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান- দেহ ও মন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দেহ ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। তাই দৈহিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যটিও সুগঠিত হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান ব্যর্থ হয়ে যায় যদি শিক্ষার্থী অটুট মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী না হয়।

5. সমাজবিজ্ঞান- ব্যক্তির শিক্ষা কীরকম হলে সমাজের উন্নতি হবে, আবার শিশুকে সমাজের উপযুক্ত নাগরিক করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা কীরকম হবে- এইসব বিষয় নিয়ে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। যার ফলে শিক্ষামূলক সমাজবিজ্ঞানের সৃষ্টি যা শিক্ষাবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।

6. শারীরবিজ্ঞান- শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর দৈহিক বা শারীরিক বিকাশে সহায়তা করা; কারণ শিক্ষা একটি বিকাশমূলক প্রক্রিয়া। শারীরবিজ্ঞান ও শিক্ষার পরিধির অন্তর্গত এই কারণে যে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্যের অভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। এ ছাড়াও অর্থনীতি (Economics) ইতিহাস (History) ইত্যাদি বিদ্যাগুলিও শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। অতএব, বলতে পারি শিক্ষার পরিধিতে বহু জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত; তাই শিক্ষা হচ্ছে ‘Multidisciplinary’ ।

শিক্ষার পরিসর ক্রমবর্ধমান। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যেসব বিষয়ের জ্ঞানকে ভিত্তি করে শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয় এবং শিক্ষার প্রধান কাজ যে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা তা করার জন্য যেসব বিষয় বা জ্ঞানগুলির সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হবে সেগুলি অর্থাৎ শিক্ষার কর্মপরিধিটিও আলোচনা করলে তবে আমাদের কাছে শিক্ষার পরিধি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাবে। নিম্নে তা আলোচনা করা হল-


1. শিশুর জীবনবিকাশের ধারা: শিক্ষাবিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ হল শিশুর শারীরিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশের বিভিন্ন দিকগুলি পর্যবেক্ষণ করা। তাই শিশুর জন্মের পর তার উক্ত বিকাশগুলি, তার ভাষার বিকাশ, তার চাহিদা ও তার কৈশোরের আচার-আচরণ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত।

2. শিশুর ব্যক্তিসত্তার বিকাশ: ব্যক্তিসত্তার বিকাশ বিষয়টি শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার সংরক্ষণগুলির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিষয়বস্তুর শ্রেণিবিভাগ করা।

3. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য: ব্যক্তি বৈষম্যের প্রভাব, বৃত্তি নির্বাচনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নীতি ইত্যাদি শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত হয়েছে। কারণ, যেহেতু সব শিশুর শিক্ষাগ্রহণের সামর্থ্য সমান নয় তাই শিক্ষার পাঠ্য বস্তু নির্বাচন, শিক্ষাদান পদ্ধতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধীয় জ্ঞান অপরিহার্য।

4. শিশুর মানসিক উপাদান: মনোবিজ্ঞানের কিছু বিষয়বস্তু, যেমন- শিশুর প্রবৃত্তি, প্রক্ষোভ, চাহিদা, স্মৃতি ও বিস্মৃতি, মনোযোগ, চিন্তন, শিখন প্রক্রিয়া, বিচারকরণ, অভ্যাস, কাজ ও ক্লান্তি, অপরাধপ্রবণতা, অনগ্রসরতা ইত্যাদি শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত হয়েছে এই কারণে যে, শিক্ষক তার পাঠদানের জন্য বিষয়বস্তু, শিক্ষণ কৌশল ও শিক্ষণ পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও গুণাবলির উপর ভিত্তি করে।

5. শিখন প্রক্রিয়া: শিক্ষাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিখন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন সমস্যার আলোচনা ও পর্যালোচনা; কারণ শিখনের ফলেই শিক্ষা হয় (Learning courses education)। তাই শিশুর চাহিদা, প্রেষণা ও পরিণমনের উপর শিক্ষা কীভাবে কতটুকু নির্ভর করে, তাকে শেখাবার উপযুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি কোন্‌টা হবে, শিখন সঞ্চালন হয় কী হয় না প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ও আলোচনা শিক্ষার পরিধিতে স্থান পেয়েছে।

6. নির্দেশনা: শিক্ষার্থীকে শিক্ষাগত নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে কী বৃত্তি গ্রহণ করলে সে Job satisfaction পাবে এবং কর্মে সফল হবে সে বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেওয়া শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়ায় শিক্ষা ও বৃত্তিগত নির্দেশনার নিয়মনীতিগুলিও শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিসরের আওতাভুক্ত।

7. শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য: মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণা, মানসিক সুস্থতা ও অসুস্থতার লক্ষণ, কেমন করে ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়, মানসিক অসুস্থতা কীভাবে নিরাময় ও নিবারণ করা যায়, শিক্ষা কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্য দ্বারা প্রভাবিত হয় ইত্যাদি বিষয় শিক্ষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম।

8. শিক্ষা প্রযুক্তি: শিক্ষককে শিক্ষা প্রযুক্তিতে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক এই উভয় প্রকার জ্ঞানের অধিকারী হয়ে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ দান এবং শিক্ষার কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে গুরুত্বসহকারে শিক্ষাবিজ্ঞানে স্থান দখল করেছে, কারণ বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে শিক্ষাব্যবস্থাও বহুলাংশে প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি শিক্ষার কাজ অত্যন্ত সহজ ও সরল করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

9. বিশেষ শিক্ষা: সাক্ষরতা অভিযান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বয়স্ক শিক্ষা, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, অনগ্রসর শিশুর সংশোধনমূলক শিক্ষা বৃত্তির মনোভাব তৈরির শিক্ষা ইত্যাদির আলোচনা সর্বাধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিসরে এসেছে।

10. মূল্যায়ন: শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মূল্যায়ন। মূল্যায়নের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারি শিক্ষার্থীর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা কার্যক্রম কতটা সফল হয়েছে। আর


এই ফিডব্যাক থেকে যদি বোঝা যায় শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা অর্জন প্রত্যাশামতো হয়নি, তখন কী ধরনের পরিবর্তন শিক্ষাক্রমে করা দরকার তা চিহ্নিত করে শিক্ষা প্রচেষ্টার পুনর্গঠন ঘটিয়ে শিক্ষাকার্যক্রমকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, মূল্যায়নের উন্নত কৌশলগুলিই বা কীভাবে ব্যবহার করা যায় ইত্যাদি মূল্যায়নভিত্তিক বিষয়গুলি আজকের যুগের শিক্ষার পরিধিতে বিশেষ স্থান পেয়েছে। সবশেষে বলতে পারি সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে শিক্ষাও এক পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া হিসেবে নিত্যই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে।

ফলে শিক্ষার তাৎপর্য, উদ্দেশ্য, পাঠক্রম, শিক্ষণ পদ্ধতি, কৌশল, মূল্যায়নের কৌশল ও পদ্ধতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হওয়ার ফলে শিক্ষাবিজ্ঞানের কর্ম পরিসর পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে, তার পরিধিও ক্রমশই বেড়ে চলেছে।


1.3. শিক্ষা এবং দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক (Relation between Education and Philosophy)



শিক্ষা ও দর্শন উভয়ে জীবন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে। কাজেই শিক্ষা ও দর্শন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত শিক্ষা জীবনব্যাপী বিকাশের এক প্রক্রিয়া অথবা শিক্ষা একটি কার্যক্রম। সচেতন স্তরে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি- আর অভিজ্ঞতাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতার শিক্ষাগত তাৎপর্য দুটি-

1. ক্রিয়া বা Action এবং 

2. ভাবনাচিন্তা বা Reflection


অভিজ্ঞতা যদি শিক্ষামূলক হয় তবে শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই দার্শনিক চিন্তাভাবনার অনুসারী হতে হবে (If experience is to be educative, action must be supplemented by relfection)। শিক্ষাক্ষেত্রে দার্শনিক মতাদর্শের প্রভাব সর্বদাই প্রতিফলিত হয়। জীবন জুড়েই শিক্ষার বিস্তার (Education is a life long process)। এই জীবন প্রতিমুহূর্তে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা বহন করে আনছে। আর সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা শিক্ষার বিশেষ সামগ্রী হয়ে উঠছে।

বাঁচা ও শেখা একই সঙ্গে চলতে থাকে। তাই ও শিক্ষা পরস্পরের পরিপূরক। শিক্ষার সঙ্গে জীবন সম্পৃক্ত বলে সে দর্শন, সমাজ, জীবন সংস্কৃতি কাউকেই উপেক্ষা করতে পারে না।



শিক্ষা, দর্শন ও জীবন


জীবন, শিক্ষা ও দর্শন পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় সংযোগে আবদ্ধ। দর্শন জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে, আর মানবসমাজের উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তিজীবনের সম্প্রসারণ ঘটানোর জন্য। 

তাই একথা বলা যায় যে, শিক্ষা এবং দর্শন ব্যক্তিজীবনের মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে। দর্শন শিক্ষার সামগ্রিক উপলব্ধিকে সম্ভব করে তোলে। দর্শনের মাধ্যমে আসে জীবনের প্রতীতি। আসে আত্মসচেতনতা ও সত্যসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি।


মানবমন উদ্ভাসিত হয়, জীবন আলোকিত হয়ে ওঠে দর্শনের আলোক শিখায়। একদিকে দর্শন যেমন জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সংকেত দেয়, অপরদিকে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ণয়ে তা নির্দেশকের কাজ করে। স্বভাবতই শিক্ষাক্ষেত্রে দর্শনের প্রভাব অপরিসীম, বস্তুত জীবনদর্শনকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে শিক্ষাদর্শন।

শিক্ষা ও দর্শন তাই আচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। সক্রেটিস -এর মতে- যাঁরা সত্যের উপাসক নন তাঁরা দার্শনিক হতে পারেন না। সত্যের উপলব্ধির জন্য দর্শন ও শিক্ষার ভূমিকা একইরূপে গুরুত্বের অধিকারী। জীবনের গতি নির্মাণে দর্শন জে জে রুশো -র মতে- কোনো মানুষের সুপ্ত বাসনার প্রস্ফুটিত রূপ হল শিক্ষা।

প্রয়োগবাদী দর্শন অনুসারে মানবজীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের দক্ষতা ও ক্ষমতা অর্জন করাই হল শিক্ষার লক্ষ্য। ভারতীয় দর্শনে আত্মোপলব্ধিই (Self-realization) হল শিক্ষার লক্ষ্য। আবার কেউ বলেন, মন ও চরিত্র গঠনই শিক্ষা। শিক্ষার সকল স্তরেই দর্শনশাস্ত্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

জন অ্যাডামস -এর মতে– শিক্ষা হল দর্শনের গতিময় দিক। জীবন কেমন হওয়া উচিত তার ব্যাখ্যা দেন দার্শনিকেরা, আর সে অনুসারে জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকদর্শন শিক্ষাকে আধুনিক অর্থে বিজ্ঞানরূপে বিবেচনা করা হলেও দর্শন তাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। তাই বিশিষ্ট দার্শনিক ফিকটে বলেন, শিক্ষা-শিল্প দর্শন ছাড়া কখনও সম্পূর্ণতা পেতে পারে না (The art of educaiton will never attain complete clearness without philosophy)।

মৌলিক তত্ত্বাবলি ও মূল্যবোধ নির্ণয় করাই দর্শনের কাজ। জীবনযাপনের পদ্ধতি হল শিক্ষা, আর সে জীবনের গতিপথ নির্দেশের কাজটি হল দর্শন। তাই শিক্ষা ও দর্শন- একটি অপরটি ছাড়া অর্থহীন। শিক্ষামনোবিজ্ঞানী রস -এর মতবাদ দর্শন ও শিক্ষা একই মুদ্রার দুটি দিক। প্রথমটি হচ্ছে ধ্যানের দিক, শেষেরটি হচ্ছে কর্মের দিক।

Ross বলেন, "Philosophy and education are two sides of a coin; the former is contemplative while the latter is the active side." জন ডিউই -র মতবাদ ডিউই -র মতে, শিক্ষাকে দর্শন থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়।

কেননা দর্শন জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন করে এবং শিক্ষা জীবনের সার্বিক উন্নতিসাধন করে। কাজেই দর্শন ছাড়া কোনো শিক্ষা কার্যক্রমই ফলপ্রসূ হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, দর্শন শিক্ষারই তাত্ত্বিক দিক। শিক্ষালয় যেন পরীক্ষাগার, যেখানে দার্শনিক সত্যগুলি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। Philosophy may be defined as the general theory of education ..... Education is the laboratory of philosophy, where the validity of philosophical truth is tested অর্থাৎ শুদ্ধ জ্ঞান বা ধারণার তাত্ত্বিক দিক ও ব্যাবহারিক দিকের মধ্যে যে সম্পর্ক, দর্শন ও শিক্ষার মধ্যে সে সম্পর্ক বিদ্যমান।

 সমাজ-আদর্শ ও শিক্ষা সমাজ নির্ধারিত আদর্শ (Ideals) নির্ণয়ে পরম শক্তিশালী মাধ্যম হল শিক্ষা। ব্যক্তি ও সভ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশের পথনির্দেশ হল শিক্ষা। শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তির অনন্ত সম্ভাবনা ও শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ-দেহ-মন-আত্মার। শিক্ষা যদি জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হয়, তবে দর্শন নিশ্চয়ই তার মূল ভিত্তি।

পার্সি নান বলেন, Every scheme of education being at bottom a practical philosophy touches life at every point. জন অ্যাডামস -এর মতবাদ শিক্ষা হল দর্শনের ফলিত ও গতিশীল দিক (Education is a dynamic aspect of philosophy)।

শিক্ষা ও দর্শনের মধ্যে বিশেষ তফাত নেই। এরা একই বিষয়ের দুটি দিকমাত্র- একটি আদর্শগত দিক, অপরটি হল সেই আদর্শের ক্রিয়াশীল দিক। মনোবিদ রস (Ross) এ প্রসঙ্গে বলেন, "Education is active aspect of philosophical belief, the practical means of realising ideals of life." শিক্ষা -সৌধের ভিত্তি দর্শন দর্শন ও শিক্ষা এত নিবিড়ভাবে যুক্ত যে, আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, দর্শন হল কাঠামো বা ভিত্তি যার উপর শিক্ষা-সৌধ গড়ে উঠেছে (Philosophy is the structure/foundation and education is the super structure)।

দর্শন ছাড়া শিক্ষা একটি অন্ধ প্রয়াস, আর শিক্ষা ছাড়া দর্শন অর্থহীন। আসলে একটি অপরটি ছাড়া অর্থহীন এবং অব্যবহার্য। নির্দেশনা বা Guidance -এর জন্য শিক্ষাকে দর্শনের উপর নির্ভর করতে হয়, আর দার্শনিক তত্ত্ব গঠনের (Formation) জন্য শিক্ষার উপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষা ও দর্শনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রমাণরূপে বলা যায় যে, সকল শিক্ষাগুরুই প্রধানত বড়ো বড়ো দার্শনিক। 
যেমন- সক্রেটিস, প্লেটো, কান্ট, হেগেল, হোয়াইট্‌হেড, ডিউই, রাসেল, বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজি, বিবেকানন্দ এবং অন্য দার্শনিকগণ যে সকল সত্য উপলব্ধি করেছেন তা তাঁরা শিক্ষার মাধ্যমে প্রচার করেন।

প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত প্রত্যেক দার্শনিকই শিক্ষাতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের অভিমত প্রকাশ করেন। শিক্ষার আদর্শ, পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ধরনের তত্ত্বের উপর তাঁদের দার্শনিক চিন্তার প্রভাব পড়েছে। লক (Locke), জন ডিউই (John Dewey) প্রত্যেকেই তাঁদের দার্শনিক চিন্তাকে কার্যকরী করার জন্য শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।

তাই তাঁরা তাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষাতত্ত্ব সম্পর্কেও আলোচনা করেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার প্রকাশ দেখি শান্তিনিকেতনে তাঁর বিশ্বভারতীর মধ্যে। ডিউই -র দর্শনের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর Laboratory School বা সমস্যাসমাধান পদ্ধতির মধ্যে।

সবশেষে সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় দর্শন শিক্ষার সব অংশকে প্রভাবিত করে। দর্শনশাস্ত্র শুধু শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করে তাই নয়, দর্শন পরোক্ষভাবে পাঠক্রম রচনার নীতি প্রণয়ন করে। দর্শনই নিরূপণ করে শিক্ষকের কর্তব্য, শিক্ষাদানের পদ্ধতি। এমনকি মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও দর্শনের পরোক্ষ ভূমিকা স্বীকৃত। এককথায়, দর্শনশাস্ত্র শিক্ষাবিজ্ঞানকে সমস্ত দিক থেকে প্রভাবিত করেছে।


1.4. শিক্ষায় দর্শনের গুরুত্ব (Importance of Philosophy in Education)



দর্শন ও শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দর্শনশাস্ত্র বিশেষভাবে শিক্ষাকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। দর্শন ও শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়, যখন আমরা দেখি বিভিন্ন দার্শনিক মতাদর্শ বর্তমান শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম পদ্ধতি ইত্যাদিকে কত গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

বস্তুত শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর নৈতিকতা জাগ্রত হয় চরিত্র গড়ে ওঠে এবং সৃজনশীলতা বিকশিত হয়। আর এই সকল বিকাশের পথ নির্দেশ করে নীতিশাস্ত্র, সৌন্দর্যতত্ত্ব ইত্যাদি দর্শনতত্ত্বের শাখা। ভারতীয় শিক্ষার বিভিন্ন যুগে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা, বৌদ্ধ শিক্ষা, মুসলিম শিক্ষা যথাক্রমে বেদান্তদর্শন, বৌদ্ধদর্শন ও ইসলামীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

শিক্ষা ও দর্শনের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনার সময় আমরা দেখেছি, শিক্ষাবিজ্ঞান এমন একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র যেখানে দর্শনশাস্ত্রের প্রভাবই সবথেকে বেশি। এই সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হবে, যদি আমরা দর্শনশাস্ত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবের দিকগুলি পৃথকভাবে আলোচনা করি।




1. শিক্ষার লক্ষ্য নির্ণয়ে দর্শন (Philosophy on the aim of Education):

মানবজীবনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক নিবিড়। তাই জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতি রেখেই শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়। শিক্ষার লক্ষ্য সবসময় একটি জীবনাদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, প্রত্যেক শিক্ষার লক্ষ্যই সমকালীন দার্শনিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর সেটাই স্বাভাবিক। দার্শনিক মতবাদ জীবন জয়ের পথে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জীবন জয়ের এই সংগ্রামে সমাজে এক বিশেষ ধরনের মূল্যবোধ (System of values) গড়ে ওঠে। এই মূল্যবোধগুলি ব্যক্তিজীবনের আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়, আর তখন সেগুলি পরিণত হয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে (Aim or Objective of education)- সেই কালের সেই সমাজের।

স্বভাবতই মূল্যবোধের পরিবর্তনে শিক্ষার উদ্দেশ্যও পরিবর্তিত হয় কালের পটভূমিতে। প্রসঙ্গত ভারবাদী শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার লক্ষ্য হল, আত্মবিকাশ ও আত্মোপলব্ধি। অধ্যাত্মবাদীগণ বিদ্যার্থীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের উন্মেষকে শিক্ষার লক্ষ্য বলে মনে করেন। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনে শিশুর অনও শক্তি, অনস্ত গুণ ও অনন্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুসমঞ্চস বৃদ্ধি ও বিকাশ -কে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার প্রয়োগবাদী শিক্ষার লক্ষ্য হল- আরও শিক্ষা (More education)।

তাঁরা শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেননি। প্রয়োগবাদী মতাদর্শে শিক্ষা জীবনের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সমব্যাপী এক প্রক্রিয়াবিশেষ।


2. শিক্ষার পাঠক্রমে দর্শনের প্রভাব (Influence of Philosophy on Curriculum):

পাঠক্রম শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিপূরণের পথ। পাঠক্রম সংক্রান্ত আলোচনা প্রসঙ্গে ব্রিগস (Briggs) বলেন, পাঠক্রমের ক্ষেত্রেই সত্যকার দার্শনিক নেতার প্রয়োজন। কারণ তিনি সুচিন্তিতভাবে উপযুক্ত বিষয়বস্তু নির্বাচনে পরামর্শ দিতে পারেন। বিষয়বস্তু নির্ণয় ও বিন্যাসকরণে দর্শনের প্রভাব অপরিসীম। ব্রিগস -এর কথায়, “It is here that education seriously needs leaders – leaders who hold a sound comprehensive philosophy of which they can convince others and who can direct its consistent application to the formulations of appropriate curricula."

শিক্ষার প্রবর্তনশীল উদ্দেশ্যের মতো পাঠক্রমও পরিবর্তনশীল। শিক্ষার আদর্শের মতো পাঠক্রমও স্থির নয়- দেশ-কাল ও ব্যক্তিভেদে তারও পরিবর্তন হয়- সমকালীন দার্শনিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রাচীন ভারতে হিন্দু, বৌদ্ধ উভয় শিক্ষাব্যবস্থারই লক্ষ্য ছিল আত্মোপলব্ধি। স্বভাবতই বেদাভ্যাস, ব্রহ্মচর্য পালন, আত্মসংযম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পাঠক্রম রচিত হত।

আধুনিক শিক্ষাক্রমে প্রকৃতিবাদ ও প্রয়োগবাদের সমন্বিত প্রভাবে চাহিদাভিত্তিক কর্মকেন্দ্রিক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক সমন্বয়ী পাঠক্রমের প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রাচীন ভাববাদী পাঠক্রমের অতিমাত্রায় পুথিনির্ভরতা ও ভাষাভিত্তিকতার প্রতিক্রিয়া রূপেই সক্রিয়তাভিত্তিক পাঠক্রমের উদ্ভব হয়েছে।


3. পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনে দর্শনের প্রভাব (Influence of Philosophy on selection of Textbooks):

পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের সময় শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পাঠক্রমের দিকে লক্ষ রেখে একটি মান (Standard) স্থির করা আবশ্যক। দর্শনশাস্ত্র এই মান নির্ণয়ে সহায়তা করে। ভালো পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে তৎকালীন জীবনাদর্শ (Life-ideal)। এই আদর্শ ও তার চর্চা শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সার্থক করে।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক রচনা পদ্ধতির বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। যেমন- প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন শিশুদের অনুরাগ সৃষ্টির জন্য পাঠ্যপুস্তকে (Textbook) যথেষ্ট ছবি ও দৃষ্টান্ত দেওয়ার পক্ষপাতী। ভাববাদী দার্শনিকগণ গ্রন্থকারের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক রচনা করার কথা বলেন। আবার প্রয়োগবাদী মতাদর্শে পাঠ্যপুস্তক রচনায় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্তি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

সহজ কথায়, সমাজে প্রচলিত আদর্শ মূল্যবোধ সৃষ্টিতে এবং তার যথার্থ প্রতিফলনে দর্শনশাস্ত্র পাঠ্যপুস্তকাদি প্রণয়নে সহায়তা করে।


4. শিক্ষার পদ্ধতি নির্ণয়ে দর্শন (Influence of Philosophy on method of teaching):


শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায়কেই শিক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতি বা উপায় অবশ্যই শিক্ষাদর্শন দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক সকল শিক্ষাপদ্ধতিই কোনো না কোনো দার্শনিক মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিলপ্যাট্রিক তাই পদ্ধতির দর্শন বা Philosophy of Method কথাটি ব্যবহার করেন।

শিক্ষাপদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আজ সর্বজনস্বীকৃত। তবে দার্শনিক মতাদর্শের বিভিন্নতা পদ্ধতির ক্ষেত্রে নানান বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে। যেমন, প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষণপদ্ধতি (Individualized Method) এবং শিক্ষা সহায়ক উপকরণ (Teaching Aids) ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।


 মহাত্মা গান্ধি -র বুনিয়াদি শিক্ষণ পদ্ধতি (Craftcentred teaching method) ফ্রয়েবেল -এর কিন্ডারগার্টেনে খেলাভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি (Play-way method of teaching) এবং মারিয়া মন্তেসরি -র স্বয়ংশিক্ষা (Auto-education) পদ্ধতি তাঁদের দার্শনিক মতবাদের ফলশ্রুতি।

ভাববাদী শিক্ষাদর্শনে, শিক্ষণ পদ্ধতির মূলকথা হল শিশুর উপর শিক্ষকের আদর্শের প্রভাব। এঁদের শিক্ষাপদ্ধতি মূলত আলোচনা, আবৃত্তি (Recitation) ও স্মৃতিচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রয়োগবাদী মতাদর্শে শিশুশিক্ষার পদ্ধতি হওয়া উচিত জীবনকেন্দ্রিক (Lifecentred)।

তাই তাঁরা চাহিদাভিত্তিক, কর্মকেন্দ্রিক ও অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির পক্ষপাতী। জন ডিউই -র মতে, শিক্ষা বাস্তব জীবনের বিবিধ সমস্যার সক্রিয় সমাধানের মাধ্যমে লাভ করা যায়।



5. শিক্ষকের ভূমিকা ও শৃঙ্খলা নির্ণয়ে দর্শন (Influence of Philosophy on the role of teacher and discipline):

শিক্ষা প্রক্রিয়ার মেরুদণ্ড হলেন শিক্ষক। শিক্ষকের জীবনদর্শন থেকেই বিদ্যার্থীর শিক্ষা ধারণার উদ্ভব। শিক্ষক নিজে যে জীবনাদর্শ বিদ্যার্থীর সামনে তুলে ধরবেন, তা-ই শিশুদের অনুপ্রাণিত করবে। শিক্ষাদর্শনের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করেই শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়ে থাকে।

যেমন- ভাববাদীরা বলেন, শিক্ষক হলেন বন্ধু, দার্শনিক ও সহায়ক (Friend, philosopher and guide)। আবার প্রয়োগবাদীদের মতে, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য সমস্যামূলক পরিস্থিতি উপস্থাপন করবেন এবং সেই সমস্যাসমাধানে তাদের সহায়তা করবেন। শিক্ষক অনন্ত জ্ঞানের আধার।

 রবীন্দ্রনাথ -এর মতে- শিক্ষক গুরু ও জ্ঞানতপস্বী। তিনি আচার্য। বিদ্যার্থীকে অনুপ্রাণিত করবেন শিক্ষক তথা আচার্য। প্রসঙ্গত শৃঙ্খলার প্রত্যয়টিও শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আধুনিক শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। আসলে, শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলার ধারণা সমকালীন রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন- একনায়কতন্ত্রে শিক্ষায় শৃঙ্খলার অপর নাম দমনপীড়ন, কঠোর অনুশাসন।

আবার গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় স্বতঃ অন্তর্জাত শৃঙ্খলাই মূলকথা।


6. মূল্যায়নের ধারণা ও দর্শন (Influence of Philosophy on Evaluation):


শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন হল বিশেষ শিক্ষণ পদ্ধতি। পাঠক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের সমবেত প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে তা নিরূপণ করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে এই যে সামগ্রিক পরিমাপ -তাই মূল্যায়ন নামে অভিহিত।

এই মূল্যায়ন যেহেতু উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে করা হয়, সেজন্য তার উপরেও দার্শনিক প্রভাব আছে। মূল্যায়নের প্রথম সোপানই হল শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনতা। এই সচেতনতা যথাযোগ্য প্রশ্নাবলি নির্বাচনে সহায়তা করে। সুতরাং, এই পদ্ধতিও দর্শনশাস্ত্র দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত।


উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়–দর্শনশাস্ত্র শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক উভয় দিককেই প্রভাবিত করেছে। দর্শন, জীবন ও শিক্ষা -এই তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন বিকাশের দিক্‌নির্ণয় করে দর্শন।

জীবনের প্রয়োজন থেকেই শিক্ষার প্রয়োজনের উদ্ভব। জীবন পরিবেশ শিক্ষার সুযোগ গড়ে তোলে। আর শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি পরিকল্পনা জীবনের লক্ষ্য দ্বারাই নির্ধারিত হয়। 

তাই শিক্ষাকে Practical Philosophy -ও বলা হয়। আসলে শিক্ষা ও দর্শন -এ দুয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এরা একে অপরের পরিপূরক। দর্শনের সাহায্য ছাড়া যেমন সার্থক শিক্ষাদান সম্ভব নয়, তেমনি শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া দার্শনিক তত্ত্বাবলির কোনো উপযোগিতা থাকে না।

বস্তুত শিক্ষা ও দর্শন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ। রাস্ক (Rusk) বলেছেন, “জীবনের দর্শন ও শিক্ষার দর্শন আজকে আর পৃথক করে ভাবা যায় না। কারণ, শিক্ষা ও জীবন এক সূত্রে গাঁথা।”



কিছু নমুনা প্রশ্ন-


1. দর্শনের অর্থ ও সংজ্ঞা লেখো। (Write the meaning and difinition of Philosophy.)

2. দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করো। (Discuss the origin of philosophical thought.)

3. দর্শনের প্রকৃতি বা স্বরূপ ব্যাখ্যা করো। (Explain the nature of Philosophy.)

4. দর্শনের বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও। (Briefly explain the subject matter of Philosophy.)

5. অধিবিদ্যা কী? এর ভাগগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। (What is metaphysics? Give a brief overview about it types.)

6. মূল্যবিদ্যা কী? এর শাখাগুলি সংক্ষেপে লেখো। (What is axiology? Briefly write about branches of it.)

7. দর্শনের কার্যাবলি বর্ণনা করো। (Explain the functions of Philosophy.)

8. আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনের মত অনুযায়ী শিক্ষার অর্থ লেখো। (Write the meaning of education according to International Educat Commission.)

9. শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাটি আলোচনা করো। (Discuss the narrow concept of education.)

10. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার ত্রুটিগুলি লেখো। (Write the demerits of education in narrow concept.)

11. শিক্ষার ব্যাপক ধারণাটি আলোচনা করো। (Discuss the broader concept of education.)

12. শিক্ষার সংকীর্ণ ও ব্যাপক ধারণার পার্থক্য লেখো। (Write the difference between narrow and broader concept of education.)

13. শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে লেখো। (Briefly write the features of education.)

14. শিক্ষার কার্যাবলি সংক্ষেপে লেখো। (Briefly write the functions of education.)

15. শিক্ষার প্রকৃতি আলোচনা করো। (Discuss the nature of education.)

16. শিক্ষার পরিধি বর্ণনা করো। (Describe the scope of education.)

17. শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করো। (Discuss the relation between education and philosophy.)

18. শিক্ষায় দর্শনের গুরুত্ব আলোচনা করো। (Discuss the importance of philosophy in education.)

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area