Environmental Pollution: Air, Water, Sound, Soil Pollution- causes and control. পরিবেশ দূষণ: বায়ু, জল, শব্দ, মৃত্তিকা দূষণের কারণ ও প্রতিকার- আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি পরিবেশ দূষণ: বায়ু জল শব্দ মৃত্তিকা দূষণের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে মূল আলোচনা।
পরিবেশ:
উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার দরকার হয় তাকে পরিবেশ বলে। পরিবেশ তৈরি হতে দরকার লাগে জল, বাতাস, মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী প্রভৃতি।
বিজ্ঞানীরা পরিবেশের নানা সংজ্ঞা দিয়েছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানী ‘বটকিন’ এবং ‘কেলার’ – ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’ গ্রন্থে বলেছেন যে-
“জীব, উদ্ভিদ বা প্রাণী তাদের জীবনচক্রের যে কোনও সময়ে যে সমস্ত জৈব ও অজৈব কারণগুলি দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেই কারণগুলির সমষ্টিকে পরিবেশ বলে।”
‘আমস’ বলেছেন-
“জীব সম্প্রদায়ের পারিপার্শ্বিক জৈব এবং প্রাকৃতিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে।”
‘দ্যা কনসাইজ’ বলেছেন যে-
“পরিবেশ হল উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের প্রভাব বিস্তারকারী বহিরঙ্গের অবস্থাগুলির ‘সমষ্টি’।”
প্রতিটি জীবের নিজের একটি আভ্যন্তরীণ পরিবেশ আছে। যাকে জীব পরিবেশ বলে। মানুষের শরীর পরিবেশকে তার আভ্যন্তরীণ পরিবেশ বলে। এর উপাদানগুলি হল- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস, কোষ, কলা, বিভিন্ন তন্ত্র ও অঙ্গ। বিভিন্ন তন্ত্রের সমন্বয়পূর্ণ প্রাণ ক্রিয়াই মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ। অসুস্থতা বা বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তনে মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবেশেরও পরিবর্তন ঘটে।
পরিবেশ দূষণ:
আমরা পরিবেশের একটি অংশ এবং পরিবেশের প্রত্যেকের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের সবসময় সচেতন থাকা উচিত যাতে এই পরিবেশ কোনও কারণে দূষিত না হয়। পরিবেশ দূষণ হল পরিবেশের স্বাভাবিক গুণমানের অবাঞ্ছিত পরিবর্তন যার প্রভাবে জীবের ক্ষতি হয়। পরিবেশের কোনও প্রতিকূল পরিবর্তন হলে জীবের জীবনের উপর তার কুপ্রভাব অবশ্যই পড়বে।
বায়ুদূষণ (Air Pollution)
বিজ্ঞানী পার্কিশ ‘এয়ার’ পলিউশন গ্রন্থে বলেছেন যে,
“আবহমন্ডলে দূষিত ধোঁয়া, গ্যাস, গন্ধ, ধোঁয়াশা, বাষ্প ইত্যাদি যে পরিমাণ ও যতক্ষণ হলে মানুষ জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি হয় বা বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা যে সমস্ত দূষিত পদার্থ মানুষের জীবন ও স্বাচ্ছন্দে বাধা দেয়, তাকে দূষণ বলে।”
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বায়ুদূষণের পরিধি ও ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি কারণ বাতাস সবচেয়ে দ্রুত দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে।
বায়ু দূষণের কারণ:
এই দূষণ মনুষ্য সৃষ্ট। তবে নানা প্রাকৃতিক কারণেও বায়ুদূষণ হতে পারে। বায়ু দূষণের কারণগুলিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
1. প্রাকৃতিক কারণ
2. মনুষ্য সৃষ্ট কারণ
প্রাকৃতিক কারণ:
i. মাটি: মাটির ধুলিকণা, মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণ ঘটায়।
ii. সমুদ্র: সমুদ্রের জলে প্রচুর পরিমাণে নানারকমের লবণ কণা থাকে। এই কণা বায়ুমন্ডলে মিশে গিয়ে বায়ুকে দুষিত করে।
iii. আগ্নেয়গিরি: আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত ছাই, খনিজ কণা, ধোঁয়া ও অন্যান্য গ্যাস বায়ুকে দূষিত করে।
iv. মহাজাগতিক বস্তু: পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা উল্কা, ধূমকেতু, গ্রহাণু থেকে নিক্ষিপ্ত ধূলিকণা, মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে পৃথিবীর বায়ুকে দূষিত করে।
v. উদ্ভিদ: বিস্তৃর্ণ বনাঞ্চলে উদ্ভিদের যখন ফুলফোটে, ফুলের পরাগরেণু তখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বায়ুদূষণ ঘটায়।
এছাড়া বনাঞ্চলের পচনশীল উদ্ভিদ সৃষ্ট মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে। আবার দাবানলের ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ব্যাপক বায়ুদূষণ ঘটায়।
মনুষ্য সৃষ্ট কারণ:
i. বিষাক্ত গ্যাসীয় পদার্থ: শিল্প কারখানা, ঘরের রান্নার কাজে ব্যবহৃত কাঠ, কয়লা প্রভৃতির ধোঁয়া, যানবাহনের ইঞ্জিনের জ্বালানির দহনে উৎপন্ন কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি বিষাক্ত গ্যাস বায়ুকে দূষিত করে।
ii. কঠিন পদার্থ ও ক্ষুদ্রকণা: কলকারখানার নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ, খনি থেকে উৎপন্ন কঠিন পদার্থের ক্ষুদ্রকণা বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণ ঘটায়।
iii. তেজস্ক্রিয় পদার্থ: পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক জ্বালানি এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পদার্থ বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে।
iv. তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র: তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রথেকে সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং উড়ন্ত ছাই বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে।
v. কীটনাশক ও আগাছানাশক: বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ও আগাছানাশক রাসায়নিক পদার্থ কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের সময় বায়ুমন্ডলকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে।
বায়ুদূষণের প্রভাব:
বায়ুদূষণজনিত কারণে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ এমনকি অজৈব বস্তুর উপর প্রভাব পড়ে। প্রশ্বাস বায়ুর মাধ্যমে বায়ুতে বিন্যস্ত দূষক গ্যাস, পার্টিকুলেট ধুলিকণা পরাগরেণু প্রভৃতি নাসারঞ্জ, শ্বাসনালী, ব্রঙ্কাই, ব্রঙ্কিওলাস হয়ে অবশেষে ফুসফুসে প্রবেশ করে সুষক কোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া অনুঘটনকারী উৎসেচকের সক্রিয়তা পরিবর্তন করার ফলে কলাকোষের স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হয়। কিন্তু বায়ু দূষক কোষ বা কোষীয় অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেহের রাসায়নিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, কার্বন মনোক্সাইড লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিনের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়ে অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দান করে।
কয়েকটি বিশেষ বায়ুদূষক কোষে মন্দ প্রভাব সৃষ্টিকারী রাসায়নিক বস্তুর নিঃসরণের মাধ্যমে কাজ করে। যেমন- কার্বন ট্রেটাক্লোরাইড বিশেষ নার্ভকোষকে উদ্দীপিত করে এপিনোক্লিন নিঃসরণ ঘটায়, নিঃসৃত অধিক পরিমাণ এপিনোক্লিন যকৃতকোষ বিনষ্ট করে। পেশাগত কারণে কর্মসস্থানের শ্রমজীবী মানুষ বায়ুদূষণের দ্বারা অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রান্ত হয়।
বায়ুদূষণের নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিকার:
বায়ুদুষণের কুফল থেকে জীবজগৎকে রক্ষা করতে হলে নিম্নলিখিত কিছু উপায় অবলম্বন করতে হবে-
i. শিল্প, কলকারখানায় ও যানবাহন ইত্যাদিতে বিভিন্ন বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে ও বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে বিষাক্ত গ্যাসগুলিকে দূর করা অথবা পরিবেশে গিয়ে তারা যাতে মিশতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ii. কলকারখানায় যে সব জ্বালানীতে ধোঁয়া কম উৎপন্ন হয় সেই সব জ্বালানির ব্যবহার করা দরকার। কয়লা, ডিজেল প্রভৃতির ব্যবহার কমিয়ে তার পরিবর্তে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
iii. কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার না করে কীটপতঙ্গ ভক্ষণকারী খাদক পতঙ্গ দিয়ে কীটপতঙ্গ ধ্বংস করতে হয়।
iv. বৃক্ষরোপণ ও বনসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
v. কঠোরভাবে ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রয়োগ করতে হবে।
জলদূষণ (Water Pollution)
বিশুদ্ধ পানীয় জল মানুষ ও সমগ্র প্রাণীকুলের জীবন ধারণের একটি অপরিহার্য উপাদান। শিল্পের অগ্রগতি এই জলকে প্রতিনিয়তই দূষিত করছে। কলকারখানার নানাবিধ পরিত্যক্ত পদার্থ ও শহরাঞ্চলের দুষিত ময়লা জল নালা নর্দমার দ্বারা বাহিত হয়ে নদী, খাল, বিল প্রভৃতির জলকে দূষিত করছে।
জলের সঙ্গে কোনও অবাঞ্ছিত পদার্থ মিশে যাওয়ার ফলে যদি জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে জলের সেই খারাপ অবস্থাকে জলদূষণ বলে। ‘মিবাস কম’ তাঁর ‘এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন’ নামক গ্রন্থে বলেছেন-
“জলের বৈশিষ্ট্য এবং গুণগত মানের কুফলদায়ী পরিবর্তনকে জলদূষণ বলে।”
বিজ্ঞানী ‘সাউথ উইক’ বলেছেন যে, “মূলত মানুষের কর্মকাণ্ড ও প্রাকৃতিক কারণে জলের প্রাকৃতিক, রাসায়নিক এবং জৈব উপদানগুলির গুণগত মান নষ্ট হওয়াকে জলদূষণ বলে।”
জলদূষণের কারণ
নানা করণে জল দূষিত হতে পারে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরা হল-
i. নগর সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও শিল্পোন্নতিই হল জলদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এর ফলে কলকারখানা ও আধুনিক শিল্পনগরীগুলি থেকে বহু দূষিত রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- ফেলন, অ্যামোনিয়া, ফ্লোরিন, অ্যালকালাইন, সায়ানাইড, আর্সেনিক, পারদ, তামা, সিসা প্রভৃতি অহরহ নালা নর্দমা দিয়ে নদী এবং সমুদ্রের জলে মিশে জলকে দূষিত করছে।
ii. কোনও শিল্প কলকারখানা, বিশেষ করে ধাতব শিল্প ও পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রথেকে অত্যন্ত গরম জল নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য জলদূষণ ঘটে।
iii. নদীর দুপাশে ও সমুদ্রের ধারে অবস্থিত শহর ও নগরের স্নানাগার, শৌচাগার ও ঘরবাড়ির ব্যবহৃত নোংরা জল নদী ও সমুদ্রের জলে অনবরত দূষণ ঘটাচ্ছে।
iv. কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশক, আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক ইত্যাদি বৃষ্টির জলের দ্বারা ধুয়ে এসে পুকুর ও নদীর জলকে দূষিত করে।
v. আধুনিক ফিসারি বা মৎস্য চাষে মাছের বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে জল দূষিত হয়।
vi. ব্যবহার্য পুকুর ও দিঘির জলে গবাদি পশুর স্নান, হাসের চাষ, রোগীর মলমূত্র লেগে থাকা জামাকাপড় ধোয়া এবং সাবান দিয়ে জামাকাপড় কাচার জন্য জল দূষিত হয়।
vii. অনেক সময় মৃত জীবজন্তু, এমনকি মানুষের মৃতদেহও নদী নালার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এতে নদী ও সমুদ্রের জল দূষিত হয়।
viii. সমুদ্রের জলে তেলবাহী জাহাজ যাওয়ার সময় যে তেল সমুদ্রে পড়ে তা সমুদ্রের জলকে দূষিত করে।
ix. সমুদ্রযুদ্ধ অথবা পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য শক্তিশালী দেশগুলি সমুদ্রগর্ভে বিস্ফোরণ ঘটায় এর ফলেও সমুদ্র জলের দূষণ হয়।
জল দূষণের প্রভাব:
i. দূষিত জল থেকে টাইফয়েড, জন্ডিস, আমাশয়, কলেরা, আন্ত্রিক, পেট খারাপ, হেপাটাইটিস, চর্মরোগ, আর্সেনিক দূষণ প্রভৃতি রোগ মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে।
ii. তামা, ক্লোরিন, পারদ, নিকেল, লোহা, সায়ানাইড ইত্যাদি মিশ্রিত জল থেকে চর্মরোগ ও পেটের রোগ দেখা দেয়।
iii. অ্যাসবেসটাস জাতীয় রাসায়নিক পদার্থে দূষিত জল থেকে অ্যালার্জি, কিডনীর সমস্যা, প্যারালাইসিস, হাড়ের বিকৃতি প্রভৃতি কঠিন রোগ দেখা দিতে পারে।
জল দূষণের নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিকার:
জলদূষণ নিয়ন্ত্রণের সাধারণ ব্যবস্থাগুলি হল-
i. পৌর এলাকার নোংরা ও বর্জ্য মিশ্রিত জলকে পরিশোধিত করার পর নদী অথবা সমুদ্রে ফেলা, তা পরিষ্কার করা অথবা আবার ব্যবহারের উপযোগী করা উচিত।
ii. কলকারখানার নোংরা জলকে পরিশোধিত করে নদী নালায় ফেলা অথবা আবার ঐ জ্বলকে কারখানার কাজে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
iii. প্লাস্টিক, মৃতদেহ, কঠিন বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি নদীতে বা জলাশয়ে ফেলা উচিত নয়।
iv. জলের অপব্যবহার ও অপচয় যথাসাধ্য বন্ধ করা দরকার।
v. কৃষি জমিতে দেওয়া রাসায়নকি বা কীটনাশক যাতে সংলগ্ন জলাভূমিকে দূষিত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।
vi. বড় জলাশয় বা নদীতে বা ব্যবহার্য পুকুরে কাপড় না কাচা, সাবান না মাখা অথবা গরু মোষ স্নান না করানো উচিত।
vii. জাহাজ থেকে তেল যাতে নির্গত হয়ে সমুদ্রের জলে না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
viii. মল, মূত্র ও হাসপাতালের দূষিত জীবাণুযুক্ত আবর্জনা জলে ফেলা উচিত নয়।
ix. পানীয় জলাধারগুলিতে নিয়মিত নির্দিষ্ট হারে কলিচুন, ব্লিচিং পাউডার, ফটকিরি প্রয়োগ করতে হবে।
শব্দদূষণ (Sound Pollution)
শব্দদূষণ বলতে বোঝায় শব্দজনিত এমন বিশৃঙ্খলা বা স্বাভাবিক শব্দমাত্রাকে অবাঞ্ছিতভাবে অতিক্রম করে আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতিসাধন করে ও সার্বিকভাবে আমাদের শারীরিক, মানসিক, স্নায়বিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থাৎ মানুষের স্বাস্থ্যের ও সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ক্ষতিসাধনকারী অবাঞ্ছিত অতিরিক্ত শব্দ বায়ুতে নির্গত হবার ফলে যে দূষণ সৃষ্টি হয়, জনজীবন বিপন্নকারী সেই দূষণজনিত সমস্যাকেই বলা হয় শব্দদূষণ।
শব্দদূষণের উৎস ও কারণ:
যেখান থেকে বা যে যে বস্তু থেকে শব্দ নির্গত হয়, তাকেই শব্দের উৎস বলে। সাম্প্রতিককালে অতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণ হল শব্দের ওই সমস্ত মনুষ্যসৃষ্ট তথা কৃত্রিম উৎসগুলির অপরিকল্পিত ও আসংগত ব্যবহার। যথা-
i. আকস্মিক প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ বা দীর্ঘস্থায়ী উচ্চমাত্রার শব্দ- যা মূলত মানুষের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম উৎস থেকে নির্গত।
ii. যানবাহনের যান্ত্রিক শব্দ ও হর্ণ, বাজি পটকার আওয়াজ এবং উৎসব অনুষ্ঠান, সভা-সমিতিতে লাউড স্পিকারের লাগামছাড়া ব্যবহার।
iii. জেনারেটর বা গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের শব্দ যেমন- ইলেকট্রিক গ্রাইন্ডার, ওয়াশিং মেসিন, মার্বেল কাটার যন্ত্র, ওয়াটার পাম্প ইত্যাদি। এছাড়াও কোলাহল, চেঁচামেচি, ঝগড়া, বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতি।
শব্দদূষণের প্রভাব:
শব্দদূষণের ফলে মানবজীবনে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। অতিরিক্ত শব্দে মানুষের মেজাজ খিটখিটে, আচরণে অস্বাভাবিকতা ও মানসিক উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের শব্দদূষণের প্রভাবে মানসিক অবসাদ বা কাজে অনীহার সৃষ্টি এবং কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।
শব্দদূষণের ফলে স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে বমিবমি ভাব, মাথা ঝিমঝিম প্রভৃতি নানা ধরনের শারীরিক অস্বস্তি সৃষ্টি করে। শব্দ যন্ত্রণা গবে এমন অনেক বিপজ্জনক ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ যে, অনেক সময় তা দুরারোগ্য হয়ে উঠছে। এই ব্যাধিগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হার্টের অসুখ, পাকস্থলীর ক্ষত ইত্যাদি।
এছাড়া মাথার যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতিরও সম্ভাবনা আছে শব্দ যন্ত্রণার প্রভাবে। এছাড়া পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজে মনসংযোগের অসুবিধা, শব্দদূষণ জনিত ক্লান্তি ইত্যাদিও আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক জীবনে ক্রমাগত ক্ষতিসাধন করে আমাদের সার্বিক জাতীয় জীবনে অবক্ষয় ঘটাচ্ছে।
শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রণ:
অতিরিক্ত শব্দমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। যথা,
i. যানবাহন নিয়ন্ত্রণ: যে যানবাহন শব্দ যন্ত্রণার একটা বড়ো উৎস, সেই যানবাহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রয়োজন। যেমন যানবাহনের যাত্রাপথের রদবদল করে এই শব্দ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যানবাহনের শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রাংশের বা মোটরের যন্ত্রের আধুনিকীকরণের দ্বারা ও যানের হর্ণের ওপর নিয়ন্ত্রণ করেও অবাঞ্ছিত শব্দের প্রকোপ কমানো যায়।
ii. কলকারখানায় আধুনিকীকরণ: কলকারখানায় বব্যহৃত শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রের আধুনিকীকরণের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে অবাঞ্ছিত শব্দ সৃষ্টি বন্ধ করতে।
iii. শব্দবাজির নিয়ন্ত্রণ: অবাঞ্ছিত শব্দের আর একটি বড়ো উৎস হল পালা-পার্বনে, উৎসবে আনন্দে বাজি-পটকার ব্যবহার। শব্দ সৃষ্টিকারী বাজির ওপরেও নিয়ন্ত্রণ এনে শব্দের উৎসে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়
iv. মাইক্রোফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: উৎসব অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোনের ব্যবহারের ওপরেও বিধি-নিষেধ আরোপ করে অবাঞ্ছিত শব্দ কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এজন্য ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক, উৎসব, পূজা ইত্যাদির সংগঠক ছাত্র-ছাত্রী সবার মধ্যেই শব্দদূষণ সংক্রান্ত সচেনতা বৃদ্ধি পেলে শব্দের উৎস নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব নয়।
v. বৃক্ষরোপন: শব্দ তরঙ্গের পথে বাধা সৃষ্টি করতে আমরা এই শব্দ যন্ত্রণার হাত থেকে। আংশিকভাবে মুক্তি পেতে পারি। শব্দের উৎস থেকে শব্দ গ্রাহক শ্রবণযন্ত্র পর্যন্ত প্রসারিত পথে শব্দকে বাধাদান করতে হলে সেই শব্দপথে গাছ লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যায়।
vi. শব্দরোধক প্লাগ ব্যবহার: দূষিত শব্দ কানে যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্যও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কানে এক ধরনের শব্দরোধক প্লাগ লাগানো যেতে পারে।
vii. সরকারী ব্যবস্থা: শব্দদূষণ সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের পরামর্শক্রমে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। সরকারীভাবেও এই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু আইনগত ব্যবস্থা ও কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। যথা-
1. পরিবেশের সুরক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ উৎসব কর্মসূচী গ্রহণ করে প্রকারান্তরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজও কিছুটা হয়েছে।
2. যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, তীব্র শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ণের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস ইত্যাদি এলাকায় হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধ করে শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সরকারীভাবে।
3. স্বাভাবিক সহনমাত্রার ওপরে (60 ডেসিবেল) যাবতীয় শব্দের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। শব্দবাজি উৎপাদন ও ক্রয়বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের সরকারী প্রচেষ্টা হয়েছে। পূজা উৎসব পার্বনে উচ্চগ্রামে মাইক্রোফোন বাজানোও আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
4. প্রশাসনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার জন্য ভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মৃত্তিকাদূষণ (Soil Pollution)
প্রধানত মানুষের অবিবেচনা প্রসূত ক্রিয়াকলাপ ও সচেতনতার অভাবে যখন ভূমির উর্বরতা হ্রাস পায়, ক্ষারকীয়তা ও অম্লতা বা লবণতা বৃদ্ধি পায়; মৃত্তিকার উপরিভাগের ক্ষয় বা অপসারণ হয়, অথবা ভূমির কার্যকারিতা ও উপযোগিতা ক্রমশই হ্রাত পেতে থাকে, তাকে মৃত্তিকা দূষণ বলে।
মৃত্তিকা দূষণের কারণ:
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমিদূষণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, মৃত্তিকা দূষণ ঘটে দুভাবে
i. প্রাকৃতিক কারণে
ii. মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের ফলে
i. প্রাকৃতিক কারণ: যে সব প্রাকৃতিক কারণে ভূমিদূষণ ঘটে, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
i. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত
ii. প্রবল বায়ুপ্রবাহ
iii. নদনদী ইত্যাদির মাধ্যমে মৃত্তিকা ক্ষয় বা মৃত্তিকার উপরিভাগ অপসারণ
iv. অ্যাসিড বৃষ্টিপাত
v. ভূমি ধ্বংস
vi. উপকূল অঞ্চলে প্লাবনের ফলে লবণতা বৃদ্ধি এবং ব্যাকটেরিয়া
vii. ভাইরাস প্রভৃতির মাধ্যমে মৃত্তিকা দূষণ।
ii. মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ: মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে ভূমিদূষণ ঘটে, যেমন-
i. যানবাহন নির্গত নানারকম ধাতুকণা (সিসা) ও তৈলাক্ত উপাদান, শহর-নগরের আবর্জনা রাশি, কলকারখানার কঠিন বর্জ্য পদার্থ প্রভৃতি।
ii. পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিকের চাদর এবং অন্যান্য জৈব পচন বিমুখ পদার্থ সমূহ, ভূমিতে সঞ্চিত হবার ফলে মৃত্তিকা দূষণ ঘটে।
iii. তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির বিপুল পরিমাণ ছাই ও অন্যান্য আবর্জনা।
iv. কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক
v. পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় আবর্জনা রাশি প্রভৃতির মাধ্যমেও ভূমি দূষিত হয়।
মৃত্তিকায় দূষণের প্রভাব:
i. বেশির ভাগ প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যায় না বলে প্লাস্টিককে ভেদ করে জ্বল, বাতাস, সার মাটিতে ঢুকতে পারে না। এতে উদ্ভিদের বৃদ্ধি হয় না ও ফল-মূল শাক-সব্জির উৎপাদন
ii. রঙিন পাতলা প্লাস্টিকের ব্যাগে যে রঙ ব্যবহার করা হয় এগুলি খুব সহজে মাটিতে মিশে মাটিকে দূষিত করে। কারণ এই রঙগুলি যথেষ্ট বিষাক্ত। ফলে মাটির স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।
iii. ভূমিদূষণের ফলে মাটিতে ক্ষয়ও বেড়ে যায়। ফলে বনভূমির আয়তন হ্রাস পায় এবং পরোক্ষভাবে বাতাসে অক্সিজেন (O) -এর পরিমাণ কমে। আবার অনেক সময় নদীতে বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
iv. ভূমিদূষণের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং সেইস্থানে মাটির জলধারণ ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
মৃত্তিকা দূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিকার:
মৃত্তিকা দূষণ রোধ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেগুলি হল-
i. কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চায় এবং বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেওয়া।
ii. উচ্চ প্রযুক্তির যেমন- কাগজ , মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন সব জৈব ও অজৈব পদার্থ, কাচ, ধাতু ইত্যাদিকে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা উচিত। এর ফলে যেমন মানুষের সম্পদের সাশ্রয় হয় তেমনি ভূমিদূষণ রোধ করা যায়।
iii. কৃষিক্ষেত্রে, পৌর এলাকা প্রভৃতি স্থান থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংগ্রহ করে জীব বিশ্লেষ্য ও অবিশ্লেষ্য পদার্থকে পৃথক করে রাখতে হবে।