Ads Area


কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি

কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি

কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি

কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি সম্পর্কে আমাদের এই পোস্ট এ সম্পুর্ণ আলোচনা করা হল। লর্ড কর্নওয়ালিস এর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যার উত্তর সকল ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। তাই আর দেড়ি না করে নিচে দেওয়া কর্নওয়ালিশের শাসন ও বিচার-সম্পর্কীয় সংস্কারগুলি আলোচনা করো? মনযোগ সহকারে পড়ুন।


কলওয়ালিশের সংস্কার

কোম্পানির শাসনকালে ভারতে আগত গভর্নর-জেনারেলদের মধ্যে লর্ড কর্নওয়ালিশ ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। বস্তুত তিনিই ভারতে আধুনিক শাসনতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর দক্ষতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সি . এইচ . ফিলিপস্ বলেছেন, “ খুব কমজনই কর্নওয়ালিশের তুলনায় অধিক স্থায়ী কাজের নমুনা উপস্থাপিত করতে পারতেন " (" Few were destined to do more permanent work than Lord Cornwallis . ")। অবশ্য কর্নওয়ালিশের শাসন-সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতীয় প্রশাসনকে গড়ে তোলা। কারণ তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইংল্যান্ডে প্রচলিত ব্যবস্থাদি সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শস্থানীয়।


শাসন-সংস্কার:

কর্নওয়ালিশ যখন এদেশে আসেন, তখন কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে উঁচুনিচু সবস্তরেই দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। অধিকাংশ কর্মচারীই বেআইনি ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত থেকে অবৈধ উপায়ে বহু অর্থ উপার্জন করত। ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ এ সংবাদ জানলেও, তা দূরীকরণে আগ্রহী ছিলেন না।

পরন্তু তাঁদের অনেকেই কী উপায়ে নিজ নিজ আত্মীয়দের ভারতে নিয়োগ করা সম্ভব হয়, তার জন্য সুযোগের সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন। কর্মচারীরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হবার ফলে সাধারণ প্রশাসন, রাজস্ব, বাণিজ্য, বিচার প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছিল।

আরও পড়ুন- সংস্কার ও পাশ্চাত্যীকরণ ভূমিকা

তিনি কোম্পানির সংকীর্ণ বণিক-চরিত্র পরিবর্তন করে প্রকৃত প্রশাসকের আদর্শ কার্যকরী করতে সচেষ্ট ছিলেন। সৌভাগ্যবশত তিনি শাসন-সংগঠনের কাজে কয়েকজন অভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মচারীর সাহায্য পেয়েছিলেন। যেমন রাজস্ববিভাগে জন শোর, জোনাথান ডানকান, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভাগে চার্লস গ্র্যান্ট, আইন-সংক্রান্ত বিভাগে উইলিয়াম জোন্‌স্ প্রমুখ।


সিভিল সার্ভিস-এর সূচনা:

কর্নওয়ালিশ একই কর্মচারীর একাধিক বিভাগে নিয়োগ বন্ধ করে দেন। তিনি নির্দেশ দেন কর্মচারীদের বাণিজ্যবিভাগ অথবা রাজস্ব বিভাগের যে-কোনো একটিতে যুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এর মতে, কর্নওয়ালিশের এই নীতির ফলেই’ভারতীয় সিভিল সার্ভিস’ (Indian Civil Service)-এর উদ্ভব ঘটে। কর্নওয়ালিশের সময় থেকেই সমস্ত প্রকার প্রশাসনিক দায়িত্ব এই শ্রেণির কর্মচারীদের উপর বর্তেছিল। তিনি সকল স্তরের কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি করে দিয়ে এবং বেআইনি উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিয়ে কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন।


বাণিজ্য সংস্কার:


বাণিজ্য-বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য কর্নওয়ালিশ কয়েকটি পরিবর্তনসাধন করেন। তিনি কাজের গতিবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য পরিচালক সংস্থা’বোর্ড অব ট্রেড’-এর সদস্যসংখ্যা এগারো থেকে কমিয়ে পাঁচ জন করেন। তখন কোম্পানি তার কর্মচারীদের মাধ্যমে ভারতীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করত।

কর্নওয়ালিশ এই প্রথা রহিত করে সরাসরি কোম্পানি এবং দালালদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেন। এটি’এজেন্সী’ প্রথা নামে খ্যাত। দুর্নীতিগ্রস্ত কন্ট্রাক্টরদের কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়। কর্নওয়ালিশ তত্ত্ববায়দের স্বার্থরক্ষার জন্য তৎপর হন এবং তারা যাতে কর্মচারীদের শোষণের শিকারে পরিণত না হয় তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।


প্রশাসনিক সংস্কার:


বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি শাসনবিভাগেও কিছু পরিবর্তনসাধন করেন। প্রথমে তিনি জেলা কালেক্টরদিগের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার দিয়েছিলেন। রাজস্বের বিষয়ে এঁরা’রাজস্ব-বোর্ড’ এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে  গভর্নর-জেনারেল এর নিকট দায়িত্ববন্ধ ছিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা ক্রমশ জটিলতা বৃদ্ধি করতে থাকে।

আরও পড়ুন- ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কারগুলি

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাসনবিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে আলাদা করে এই জটিলতা দূর করেন। তিনি ৩৫ টি জেলাকে পুনর্বিন্যাস করে ২৩ টি জেলায় পরিণত করেন।


পুলিশ-বিভাগে সংস্কার:


পূর্বে গ্রামাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল গ্রামীণ জমিদারদের হাতে। কর্নওয়ালিশ এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেন এবং একটি সুবিন্যক্ত পুলিশবাহিনীর উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেন। কলকাতায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ কমিশনার পদের সৃষ্টি করেন।

জেলাগুলিতে কয়েকটি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতি থানায় কনস্টেবলসহ দারোগা নিযুক্ত হত। শহরগুলিতে কয়েকটি পুলিশ সুপারিনটেনইডেন্ট-পদের সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এদের ব্যয়ভার সরকার বহন করতেন। তিনি কর্মচারীদের সততা ও নিয়মানুবর্তিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য তিনি অনেকগুলি আচরণবিধি তৈরি করেন। এগুলি’ কর্নওয়ালিশ কোড’ (Cornwallis Code) নামে পরিচিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উচ্চ কর্মচারী পদে কর্নওয়ালিশ ভারতীয়দের নিয়োগের প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতীয়গণ অযোগ্য এবং দুর্নীতিগ্রক্ত, আসলে তিনি ছিলেন অন্ধ জাতীয়তাবাদী।


বিচার-সংস্কার: ফৌজদারি বিচার:


কর্নওয়ালিশের বিচার সংস্কারও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংস-প্রবর্তিত বিচার কাঠামো মোটামুটি বজায় রেখেই তাকে আরও সুবিন্যক্ত করার জন্য কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেন।

(১) তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে সদর নিজামত আদালতটি কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন এবং বিচারের ভার নবাবের পরিবর্তে গভর্নর-জেনারেল ও তাঁর পরিষদের হাতে ন্যস্ত করেন। দেশীয় আইনকানুন সম্বন্ধে তাঁদের অবহিত করার জন্য কাজি ও মুফতি নিয়োগ করা হয়।

(২) সদর নিজামত আদালতের অধীনে চারটি ভ্রাম্যমাণ বিচারালয় (Court of Circuit) গঠন করা হয়। এগুলির প্রতিটিতে দুজন করে ইংরেজ বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। বিচারকেরা বছরে দুবার করে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। বিচারকদের সাহায্য করতেন কাজি ও মুফতি।

(৩) বিচারব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরে সদর আমিন ও মুসেফি বিচারালয় স্থাপন করা হয়।

(৪) মুসলমান ও অ-মুসলমান সাক্ষীর মধ্যে পূর্বে যে তারতম্য ছিল, কর্নওয়ালিশ তার অবসান ঘটান। সাক্ষীকে একজন মুসলমান সাক্ষীর সমান বলে গণ্য করা হত। কর্নওয়ালিশ উভয় শ্রেণির সাক্ষীকে সমান মর্যাদা দান করেন।

(৫) পূর্বে নরহত্যা রাষ্ট্রীয় অপরাধ (State Crime) বলে গণ্য হত না। নিহত আত্মীয়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর হত্যাকারীর বিচার ও শাস্তি নির্ভর করত। কর্নওয়ালিশ আইন জারি করে’হত্যাকাণ্ড’ কে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং সমাজের হাতেই অপরাধীর শাস্তিবিধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।

(৬) কর্নওয়ালিশ অঙ্গচ্ছেদ, বেত্রাঘাত জাতীয় নিষ্ঠুর ও অমানবিক দণ্ডদান রীতি তুলে দেন।


দেওয়ানি বিচার:


কর্নওয়ালিশ দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাকে রাজস্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান।

(১) দেওয়ানি বিচারের সর্বনিম্নে ছিল সদর আমিন ও মুন্‌সেফি আদালত।

(২) এদের উপরে প্রতি জেলায় ছিল একটি করে জেলা দেওয়ানি আদালত। এগুলি একজন করে ইংরেজ বিচারপতির অধীনে থাকত। ভারতীয় আইনবিদ্‌গণ জেলা জজকে বিচারকার্যে সাহায্য করতেন।

(৩) জেলা-বিচারালয়ের উপরে ৪ টি প্রাদেশিক দেওয়ানি আপিল আদালত স্থাপিত ছিল। এগুলি কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, মুর্শিদাবাদে অবস্থিত ছিল। এগুলির বিচার পরিচালনা করতেন ইংরেজ জজগণ।

(৪) সমগ্র দেওয়ানি বিচারের সর্বোচ্চে ছিল সদর দেওয়ানি আদালত। স-পরিষদ গভর্নর-জেনারেল এই আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

যুক্তিপূর্ণ সুবিন্যক্তকরণের মধ্য দিয়ে কর্নওয়ালিশ ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে জনমুখী করে তুললেও, তিনি জোরপূর্বক নবাবের বিচারক্ষমতা- হরণ করেছিলেন বলে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ বন্ধ করেও তিনি ভারতীয়, প্রতিভা ও যোগ্যতার অমর্যাদা করেছিলেন। অবশ্য এসব ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় শাসন ও বিচারব্যবস্থা বহুলাংশে উন্নত হয়েছিল।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area