Ads Area


মহাবীরের জীবনী ও তাঁর শিক্ষার সংক্ষিপ্ত বিবরণ | Biography Of Mahabir And His Teachings

মহাবীরের জীবনী ও তাঁর শিক্ষার বিবরণ | Biography of Mahavira and details of his teachings

মহাবীরের জীবনী ও তাঁর শিক্ষার বিবরণ | Biography of Mahavira and Details of His Teachings


জৈনধর্ম (Jainaism): 


প্রশ্ন। মহাবীরের জীবনী ও তাঁর শিক্ষার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । (Give a brief account of life and teachings of Mahavira.)


উত্তর-

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে ধর্মবিপ্লবের ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পরিবর্তে একাধিক নতুন ধর্মভাবনার উন্মেষ ঘটে । এইসব নতুন ধর্মমতের মধ্যে জৈনধর্ম ছিল অন্যতম প্রধান । জৈন মত অনুসারে চল্লিশ জন তীর্থঙ্কর বা ধর্মগুরু এই মত প্রচার করেন । এঁদের মধ্যে শেষ দু’জনকেই ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তি’ বলে মনে করা হয় । বাকীরা ছিলেন কল্পলোকের অধিবাসী । শেষ দু'জন তীর্থঙ্কর ছিলেন পার্শ্বনাথ ও মহাবীর । পার্শ্বনাথ ছিলেন কাশীর যুবরাজ এবং মহাবীরের প্রায় আড়াইশ’ বছর পূর্বে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল । মাত্র ৩০ বৎসর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন । পার্শ্বনাথ চারটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের নির্দেশ দিয়েছেন । এগুলি হল-

(1) মিথ্যা কথা না-বলা

(2) প্রাণী হত্যা না-করা

(3) চুরি না-করা এবং

(4) বিষয় সম্পত্তির প্রতি অনাসক্ত থাকা ।


মহাবীর:

জৈন ধর্মমতের প্রকৃত বিকাশ ঘটে বর্ধমান মহাবীরের নেতৃত্বে । আনুমানিক ৫৪০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বৈশালীর নিকটবর্তী কুন্দগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । মহাবীরের পিতা সিদ্ধার্থ কুন্দপুরের জ্ঞাতৃকগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন । মা ত্রিশলা ছিলেন লিচ্ছবীনেতা চেতকের বোন । যশোদা নাম্নী এক ক্ষত্রিয়নারীকে তিনি বিবাহ করেন । তাঁর একটি কন্যাসন্তানও ছিল ।

কিন্তু সংসারের মায়া ত্যাগ করে মাত্র ত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । দীর্ঘ বারো বৎসর কঠোর তপস্যা করে তিনি ‘কৈবল্য’ বা সিদ্ধিলাভ করেন এবং ‘জিন’ ও ‘নির্গ্রন্থ’ নামে পরিচিত হন । ‘জিন’ শব্দের অর্থ হল জয়ী । অর্থাৎ যারা সবরকম লোভ, মায়া ও হিংসা জয় করতে পারে, তারাই হল ‘জিন’ । ‘জিন’ শব্দটি থেকেই ‘জৈন’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে । মহাবীর পার্শ্বনাথের চতুর্যামের সাথে ‘ব্রহ্মচর্য’ ব্রতটিকে জৈনদের পালনীয় রূপ যোগ করেছেন । আনুমানিক ৪৬৮ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে মহাবীর দেহত্যাগ করেন ।


জৈন ধর্মমত:

জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়নি । জৈনমত অনুসারে বিশ্ব-সৃষ্টি ও রক্ষার পেছনে কোন দৈব অনুগ্রহ নেই । এই বিশ্ব অনন্ত । এখানে উন্নতি ও অবনতি চক্রবৎ পরিবর্তিত হয়ে আসে । জৈনরা জীবের ব্যাপক অস্তিত্বে বিশ্বাসী ।

এদের মতে জীব শুধু প্রাণীজগতেই নেই, লতা-গুল্ম, মাটি, পাথর, ধাতু প্রভৃতিতেও প্রাণ আছে । জৈব ও অজৈব সবই সমান, কেবল বস্তুর অনুষঙ্গেই তারা ভিন্ন হয়ে যায় । জৈনমতে এই বস্তুটি হল কর্ম; মানুষের জীবনে কর্মের শেষ নেই । এই কর্মের বন্ধনই জীবকে অপবিত্র করে । কৃতকর্মের ফলভোগ করতেই জীবের পুনর্জন্ম ঘটে । এই কর্মবন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই মানুষের বা জীবের মুক্তি ঘটবে । জৈনধর্মের লক্ষ্যই হল এই মোক্ষ বা মুক্তিলাভ । মুক্তিলাভের জন্য জৈনধর্মে সৎ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ- এই তিনটি নীতি বা ‘ত্রিরত্ন’ পালন করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে । জৈনগণ কৃচ্ছ্বসাধনে বিশ্বাসী এবং কঠোর তপশ্চারণ আত্মোপলব্ধি ও সিদ্ধিলাভের সহায়ক বলে মনে করে ।

জৈনধর্মে মঠ- জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । জৈনদের সাধনা একান্তভাবে ত্যাগের ও পবিত্রতার সাধনা । জৈন সন্ন্যাসী পূজ্যপাদ সুন্দরভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন । তাঁর মতে: দেহ, গৃহ, স্ত্রী-পুত্র, মিত্র বা শত্রু, -সবই জীব থেকে আলাদা । বোকারাই এদের আপন ভাবে । তিনি জরা, মৃত্যু সবকিছুকেই অস্বীকার করে বলেছেন- কৈশোর, যৌবন, রূপ সৌন্দর্য, জরা বা মৃত্যু -এসবই শরীরের বিশেষ অবস্থা । ‘আমি’ এর থেকে স্বতন্ত্র, তাই এসবে আমাদের আনন্দ বা দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই ।


জৈনধর্মের বিস্তৃতি: 

প্রথমে জৈনধর্ম প্রধানত মগধ, কোশল, বিদেহ ও অঙ্গ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল । পরবর্তীকালে তা দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে । মৌর্যযুগে জৈনদের প্রভাব রাজানুগ্রহে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, কলিঙ্গরাজ খারবেল প্রমুখ এই ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মগধে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জৈনধর্মাবলম্বী বহু লোক ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে চলে আসেন । কিন্তু আরও অনেক স্থূলভদ্রের নির্দেশে মগধেই থেকে যান ।

এই ঘটনার ফলে জৈনদের মধ্যে দুটি সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় । ভদ্রবাহু মহাবীরের অনুশাসন অনুসারে জৈনদের বস্ত্রত্যাগের নির্দেশ দেন, এরা ‘দিগম্বর’ নামে পরিচিত হন । কিন্তু স্থূলভদ্রের নির্দেশে অন্যেরা পার্শ্বনাথের মতানুযায়ী ‘শ্বেতবস্ত্র’ পরিধানের নীতি গ্রহণ করেন । এঁরা ‘শ্বেতাম্বর’ নামে পরিচিত হন । গুপ্তযুগের সূচনায় জৈনধর্ম পূর্বে উড়িষ্যা থেকে পশ্চিমে মথুরা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । পরবর্তীকালে গুজরাট, কাথিয়াবাড় ও রাজস্থানে এই ধর্ম কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে । এই অঞ্চলে প্রাধান্য ছিল শ্বেতাম্বর- গোষ্ঠীর, কিন্তু হায়দ্রাবাদ ও দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য অঞ্চলে প্রাধান্য ছিল দিগম্বর-সম্প্রদায়ের ।


জৈন ধর্মগ্রন্থ: 

পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের উপদেশাবলী প্রথমে মুখে মুখেই প্রচারিত হত । জৈন-শ্রমণ ভদ্রবাহু রচিত ‘কল্পসূত্র'ই জৈনদের প্রথম লিখিত গ্রন্থ । এতে চৌদ্দটি পর্বে মহাবীরের বাণী বিশ্লেষণ করা হয়েছে । আনুমানিক ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রে আহূত প্রথম জৈন সঙ্গতিতে পূর্বের ১৪ টি পর্বের পরিবর্তে জৈনশাস্ত্রকে বারোটি অঙ্গে সংকলিত করা হয় । একে বলা হয় ‘দ্বাদশ অঙ্গ’ । পরে বলভীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলনে কিছু সংশোধন করে আরও ১২ টি অনুশাসন যোগ করা হয়, এগুলি ‘দ্বাদশ উপাঙ্গ’ (উপ+অঙ্গ) নামে পরিচিত হয় ।


অবদান:

ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে জৈনধর্মের অবদান অপরিসীম । ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামি, আচার-সর্বস্ব ধর্মাচরণ ও সামাজিক শ্রেণীভেদ -এর পরিবর্তে জৈনধর্ম সহজ সরল ও শ্রেণীহীন ধর্মবিশ্বাসের আলোেক প্রজ্বলিত করেছিল । এই ধর্ম বৌদ্ধধর্মের মত ভারতের বাইরে হয়তো প্রচারিত হয়নি, কিন্তু স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল এই ধর্মবিশ্বাস এখনও ভারতের বহু মানুষ কর্তৃক অনুসৃত হয় ।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area