Ads Area


আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার উপাদান | An Element Study History Of Modern India

আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার উপাদান | An Element Study History Of Modern India



আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার উপাদান | An Element Study History Of Modern India



আধুনিক ভারত-ইতিহাসের উপাদানগুলি বিবরণ দাও । (Describe the sources of Modern Indian History.)


উত্তর। ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের ইতিকাহিনিকে যে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন, তার শেষ পর্যায় হল আধুনিক যুগ । মােটামুটিভাবে ভারতে বিদেশি বণিকদের আগমন কাল থেকেই এই যুগ শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে । পূর্ববর্তী দুটি যুগ অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারত-ইতিহাস রচনা উপাদানের অপ্রতুলতা-হেতু খুব সহজসাধ্য ছিল না, -একথা আমরা সবাই জানি । কিন্তু আধুনিক ভারত-ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আমাদের সে জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি ।

কারণ এই পর্যায়ে এসে এমন কতকগুলি উপাদান সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে, যা ইতিহাস আলােচনার কাজ সহজসাধ্য করেছে । তবে ইতিহাসে শেষ কথা বলে কিছু নেই । ইতিহাসের দুয়ার সমালােচনার জন্য সদা উন্মুক্ত । তাই উপাদানের প্রাচুর্য সত্ত্বেও আধুনিক ভারত ইতিহাসে ঘটনার চরিত্র বা প্রকৃতি ও কারণ নিয়ে দ্বিমতের অবতারণা বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে । তবুও নির্দ্বিধায় বলা যায়, আধুনিক কালের উপাদানগুলি ছিল অনেক বেশি বিস্তারিত, যুক্তিসংগত এবং তাই নির্ভরযােগ্য ।


উপাদানসমূহ: সাধারণভাবে আধুনিক ভারত-ইতিহাসের উপাদানগুলিকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করে নিতে পারি ।

যথা- 

(১) সরকারি দলিলপত্র (Official records)

(২) দেশীয় রচনা (Local writings) এবং

(৩) বিদেশি ঐতিহাসিকদের রচনা (Writings of foreign Historians) |


সরকারি দলিলপত্র: নিঃসন্দেহে কোনাে একটি সময়ের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্বন্ধে জানার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল, সরকারি কাগজপত্র । প্রাচীনকালে ভারতের সরকারি কাজকর্ম লিখিত নির্দেশের ভিত্তিতে বলে, আমরা এই মহামূল্যবান উপাদান থেকে বঞ্চিত হয়েছি । মধ্যযুগে কিছু কিছু লিখিত নির্দেশ থাকলেও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না ।

কিন্তু আধুনিক যুগে এই অভাব প্রায় ছিল না । বিশেষত ইউরােপীয় বণিকরা ভারতে আসার পর সরকারি কাজে কাগজপত্রের ব্যবহার প্রাধান্য পায় । ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা (Board of Directors) কোম্পানির ভারতস্থ কাউন্সিলকে সকল প্রকার কাজের বিবরণ লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন ।

অতঃপর কোম্পানি এবং ব্রিটিশ সরকার পরিচালনাধীন সরকারের বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক সমস্ত কাজই লিখিত নির্দেশের ভিত্তিতে করা হয় । কালক্রমে সরকারের কার্যক্রমের বিবরণ-সম্বলিত নানা প্রকারের নথিপত্র, চিঠিপত্র ও স্মারকপত্র সংরক্ষিত হতে থাকে । ফরাসি পর্যটক জ্যাকমোঁ (Jacquemont), ভারত সরকারের সরকারি কাগজপত্রের প্রাচুর্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ভারত-সরকার কাগজ-কলম দ্বারা পরিচালিত । এইসব সরকারি দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের জন্য স্থাপিত হয়েছে একাধিক মহাফেজখানা (Archieves) । এগুলির মধ্যে প্রধান হল দিল্লিস্থ জাতীয় মহাফেজখানা । এ ছাড়া কলিকাতা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, পুনে ও লাহােরে রয়েছে আঞ্চলিক মহাফেজখানাগুলি । এইসব মহাফেজখানায় বহু নথি পাণ্ডুলিপি আকারেই সংরক্ষিত আছে ।


ইন্ডিয়া অফিস: আধুনিক ভারত-ইতিহাস রচনায় সরকারি নথিপত্র প্রাপ্তির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল লন্ডনে অবস্থিত ইন্ডিয়া অফিস । প্রাচ্যের ইতিহাস রচনার জন্য এই গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম । এখানে প্রায় পনেরাে হাজার পাণ্ডুলিপি এবং দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মুদ্রিত গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে । এ ছাড়া আছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিল-দস্তাবেজ ।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাগজ ও গ্রন্থ এই অফিসে রয়েছে । এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দলিলপত্রের সাহায্যে জনৈক ব্রিটিশ পণ্ডিত ওর্মী (Orme) History of Military Transaction গ্রন্থটি রচনা করেন (১৭৬৩ খ্রিঃ) । এই গ্রন্থ থেকে ব্রিটিশ-ভারতের বহু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানা যায় । ওলন্দাজ ও পাের্তুগিজ বণিকরাও বহুদিন এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল । তাই ডাচ্ মহাফেজখানা এবং লিসবনে স্থাপিত পাের্তুগিজ মহাফেজখানা থেকেও সমসাময়িক ভারতের বহু তথ্য জানা যায় । পণ্ডিচেরিতে স্থাপিত ফরাসি মহাফেজখানাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য ।


মারাঠি ও ফারসি রচনা: দেশীয় ভাষায় রচিত বিভিন্ন পুস্তকাদি থেকেও আধুনিক ভারত-ইতিহাসের নানা তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে । ফারসি বা মারাঠি ভাষায় রচিত এইসব দেশীয় সাহিত্য ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে অপরিহার্য না-হলেও, এগুলি থেকে অষ্টাদশ শতকের ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে ।

গুলাম হােসেন রচিত সিয়ার-উল-মুতাখরিন, করম আলি রচিত মুজফ্ফরনামা ফারসি গ্রন্থ দুটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য । রানাডে রচিত পেশােয়দের দিনপঞ্জী নামক গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট মারাঠি কাগজপত্রের ঐতিহাসিক উপাদানও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । তামিল ভাষায় রচিত আনন্দ-রঙ্গ পিল্লাই -এর ডায়েরী এবং ফরাসি গভর্নর ডুপ্লের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দুবাস’গ্রন্থ দুটিও ঐতিহাসিক উপাদানে সমৃদ্ধ । এই দুটি গ্রন্থ থেকে দক্ষিণ-ভারতে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব ও আঞ্চলিক ভারতীয় শক্তির ক্রম-অধঃপতনের বহু তথ্য পাওয়া যায় । এ ছাড়া রাজওয়াদে, খের প্রমুখ মারাঠি ঐতিহাসিকদের রচনা থেকেও বহু মূল্যবান ইতিহাস জানা যায় ।


ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের রচনা: আধুনিক ভারত-ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিদেশি ঐতিহাসিকদের বিশেষত ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের রচনাবলি উল্লেখযােগ্য । ভারতে ব্রিটিশ শক্তির অভ্যুত্থান ও ভারতীয় শক্তিগুলির বিচ্ছিন্নতার বহু মূল্যবান কাহিনি এইসব পুস্তক বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় । এই প্রসঙ্গে জেমস মিল রচিত British Indian History, উইলস্ রচিত হিস্ট্রি অব মাইশাের, গ্রান্ট ডাফ রচিত পেশােয়া দপ্তর এবং কানিংহাম রচিত শিখ ইতিহাস এর নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । ১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বহু ব্রিটিশ লেখক পুস্তক রচনা করেছেন, যা ঐতিহাসিক গুণে সমৃদ্ধ । এগুলির মধ্যে জন কে. চার্লস রেকস্, ফরেস্ট, গ্রিফিন, রবার্টস, নর্টন হােমস্ প্রমুখের রচনা বিশেষ উল্লেখযােগ্য ।


জাতীয়তাবাদী রচনা: ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা এবং জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ, সরকারি দলিলপত্র প্রভৃতি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মূল্যবান । এই ধরনের গ্রন্থের সংখ্যা বিশাল । এগুলির মধ্যে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল দাদাভাই নৌরজীর ইন্ডিয়ান পােভার্টি অ্যান্ড এন আন ব্রিটিশ রুল, রমেশচন্দ্র দত্তের ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, অ্যানি বেশান্তের হাউ ইন্ডিয়া ফটু হার ফ্রীডম, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর এ নেশন ইন মেকিং, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম ইত্যাদি ।

এ ছাড়া, মহাত্মা গান্ধি, জওহরলাল নেহরু, কার্জনের স্বরাষ্ট্র সচিব হবার্ট রিজলে, আলিগড় আন্দোলনের পথিকৃৎ স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ প্রমুখের ‘আত্মজীবনী’, ‘দিনলিপি’, ‘পত্রাবলী' ইত্যাদিও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মহার্ঘ । সরকারি দলিলের মধ্যে ‘সিডিশন কমিটির রিপাের্ট’ -এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ।


সমাজ ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ: সমকালীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বা আন্দোলনের ইতিহাস জানার জন্য সমসাময়িক সমাজ ও ধর্মবিষয়ক পত্রপত্রিকাগুলি বিশেষভাবে সাহায্য করে । এক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযােগ্য । ভারতীয় সমাজ ও ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করে সেকালের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন ।

এগুলির মধ্যে সতীদাহ বিষয়ক প্রবন্ধ, বিভিন্ন উপনিষদের বঙ্গানুবাদ ‘প্রিসেপ্টস্ অব জেসাস সংবাদকৌমুদি' পত্রিকা প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা, শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ; ইয়ং বেঙ্গলগােষ্ঠী প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক গ্রন্থ ইত্যাদি থেকে আমরা ঊনবিংশ শতকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তনের নানা মূল্যবান তথ্য পাই । ভারতীয়দের দ্বারা রচিত ইতিহাসের আকর-গ্রন্থ হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থের অবদান অবিস্মরণীয় ।


সংবাদপত্র: সংবাদপত্র যেমন জনমত গঠন করে, তেমনি ইতিহাসের সূত্রধর হিসেবেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । তখন ভারতে সংবাদপত্র প্রকাশের সূচনা হয়েছে ।

স্বভাবতই এগুলি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । এ প্রসঙ্গে হিকির বেঙ্গল গেজেট শ্রীরামপুর মিশনারিদের ‘দিগদর্শন' পত্রিকা; ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর ‘স্পেক্টেটর জ্ঞানান্বেষণ' পত্রিকা, সুরেন্দ্রনাথের ‘দি বেঙ্গলী ব্রহ্মবান্ধবের সন্ধ্যা অরবিন্দের যুগান্তর তিলকের ‘কেশরী মাদ্রাজের ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার নাম উল্লেখযােগ্য । বিদেশ থেকে প্রকাশিত পত্র, ও সংবাদপত্রসমূহও এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করে ।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area